সিলেট মহানগরীতে হকারদের দৌরাত্ম্যের কারণে সংকুচিত হয়ে গেছে ফুটপাত ও রাস্তা। বেড়েছে যানজট। একই সঙ্গে যত্রতত্র বেড়েছে সিএনজি অটোরিকশা পার্কিং। পুলিশের অনুপস্থিতি ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে নগরীর ফুটপাত ও রাস্তা দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে হকাররা।
ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে তারা। যদিও সিসিকের পক্ষ থেকে দিনের বেলায় নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান হয়। অথচ দিনের বেলা এমনিতেই হকাররা খুব একটা বসে না। তখন রাস্তা-ফুটপাত খালি থাকে। তারা মূলত বিকেল থেকে সন্ধ্যার পরপরই রাস্তাজুড়ে নেমে পড়ে।
এদিকে ঈদ সামনে রেখে হকারদের ভিড়ে পকেটমার, ধাক্কা পার্টি, মলম পার্টি তাদের কাজ সেরে নিচ্ছে। এতে রাস্তায় চলাচলকারী, পথচারীসহ অনেকেরই টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র খোয়া যাচ্ছে।
সিলেটের হেতিমগঞ্জ থেকে নগরীতে ঈদের বাজার করতে আসা মায়মুনা বেগম বলেন, রমজানের প্রথম দিকে মার্কেটগুলোতে ভিড় কম থাকে, তাই ঈদের বাজার করতে আসছিলাম। কিন্তু বন্দরবাজার কুদরতউল্ল্যাহ মার্কেটের সামনে সিএনজি থেকে নামার পর হেঁটে শুকরিয়া মার্কেটে যাওয়ার পথে অগ্রগামী স্কুলের সামনে হকারদের ভিড়ে কেউ একজন পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল, কিছুক্ষণ পর দেখি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টাকা ও মোবাইল গায়েব। যা সম্বল ছিল তা নিয়ে গেছে। এখন নাতি-নাতনিদের কী দিয়ে বুঝ দেব কিছুই বুঝতেছি না। তারা তো ঈদের জামা-কাপড়ের অপেক্ষায় আছে।
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় আমার যে ক্ষতি হয়েছে তার কি কোনো খোঁজ নেবেন জনপ্রতিনিধি বা রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা। তাদের মদদ ছাড়া কি এসব অপরাধ সংঘটিত হতে পারে? নিশ্চয়ই এসব অপরাধের পেছনে তাদের পরোক্ষ মদদ আছে। এদের একটা অংশের ভাগ তারা পান। তা না হলে কেন এসব বন্ধ হয় না? জনপ্রতিনিধি বা রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা চাইলেই এসব অপরাধ ও হকার উচ্ছেদ করা সম্ভব। থাকতে হবে সদিচ্ছা।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার বলেন, সিলেট নগরীর হকার সমস্যাটা অনেক পুরোনো। আমি মাত্র কয়েক দিন হয় যোগদান করেছি। শিগগিরই পুলিশ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ হবে। কারণ সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে রাস্তা-ফুটপাত দখলমুক্ত করা সম্ভব নয়। সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগের মাধ্যমে হকার সমস্যার সমাধান করতে হবে।
নগরীর জিন্দাবাজার পুরান লেন এলাকার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, হকারদের যন্ত্রণায় বাসা থেকে হেঁটে বের হওয়াটাই কঠিন। ছেলে-মেয়ে নিয়ে বের হলে সব সময় আতঙ্কে থাকি। কখন তাদের কারণে ছিনতাই বা ধাক্কা পার্টির কবলে না পড়ি। হকারদের ভিড়ে পকেটমার, ধাক্কা পার্টি, মলম পার্টি ওত পেতে থাকে। আলাদা করে তাদের চেনার কোনো উপায় নেই।
পুলিশের অনুপস্থিতি ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে হকারদের ভিড়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে সুযোগসন্ধানীরা। এর পেছনে রয়েছে স্থানীয় নেতাকর্মী ও পুলিশের মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিন হকার প্রতি ১৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। পরে তা ভাগবাটোয়ারা করেন মদদদাতারা।
তিনি বলেন, মহানগরীর ফুটপাত ও রাস্তা দখলমুক্ত রাখার সদিচ্ছা পুলিশের থাকলে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদেক্ষপ গ্রহণ করত। এতে তাদের ওপর ওঠা চাঁদাবাজির অভিযোগের বদনাম ঘুচে যেত। আর প্রকৃত চাঁদাবাজদের মুখোশ উন্মোচন হতো, নগরবাসী জানতে পারত কারা এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে পুলিশ। রাস্তা ও ফুটপাত হকারমুক্ত রাখতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে অভিযানের পরপরই হকাররা ফের রাস্তায় নেমে আসে। দিনরাত দাঁড় করিয়ে রাখার মতো এত পুলিশ আমাদেরও নেই। এরপরও আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা আরও কঠোর হব। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে পুলিশ পর্যবেক্ষণ করছে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের ওপর হামলাকারী হকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে এর পেছনের কারণ বের করে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আগের খবর জানি না, তবে ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশ কোনো অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নয়। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালে হকার পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ওই বছরের জানুয়ারিতে নগর ভবন লাগোয়া লালদীঘির পাড়ের খোলা মাঠে হকারদের জন্য অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন তিনি। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বেশিদিন সেখানে থাকেননি।
তার কারণ ছিল, তাদের লাইটিং সমস্যা ও রাস্তা। ২০২১ সালে প্রাথমিকভাবে নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে এক হাজার ৭০ হকারকে পুনর্বাসন করা হয়। তবে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভেস্তে যায় হকার পুনর্বাসনের এ উদ্যোগ। সিসিক নির্মিত অস্থায়ী মার্কেটে হাতেগোনা কয়েকটি দোকান ছাড়া আর বসেন না কেউ। উল্টো নগরের ফুটপাত ছাপিয়ে সড়কেরও বহুলাংশ দখল নিয়েছিলেন তারা। ফলে দিনভর নগরে লেগে থাকত যানজট।
এরপর গেল বছর সদ্যঃসাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ফের নগরীর ভ্রাম্যমাণ হকারদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন। কোটি টাকা ব্যয়ে নগর ভবনের পাশের লালদীঘির পাড় এলাকায় অস্থায়ী বিপণিবিতান (মার্কেট) নির্মাণ করা হয়।
সেখানে মাটি ভরাট, ইটের সলিং, বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থাসহ সব কাজ শেষে ২০২৪ সালের ১০ মার্চ তৃতীয়বারের মতো হকারদের নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে হকার পুনর্বাসন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ওই দিনই স্থানটি হকারদের ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এসব দোকানে আড়াই থেকে তিন হাজার হকারকে একসঙ্গে বসে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়।
তখন সিসিক কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন হার্ডলাইনে থাকায় বাধ্য হয়ে ফুটপাত ছেড়ে নতুন ঠিকানায় চলে যান হকাররা। এর পর থেকে কয়েক মাস নগরীর রাস্তা-ফুটপাত হকারমুক্ত ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ফের বদলে গেছে দৃশ্যপট। বর্তমানে নগরের ফুটপাত ছাপিয়ে সড়কেরও বহুলাংশ দখলে নিয়েছেন তারা। ফলে দিনভর নগরে লেগে থাকে যানজট। ভোগান্তিতে নগরবাসী।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, মহানগরীর হকার সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। রাস্তা-ফুটপাত দখলমুক্ত করা শুধু পুলিশ বা প্রশাসনের দ্বারা সম্ভব না। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা হকার সংগঠনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। একসময়ের হকার্স লীগ এখন হকার্স দলে পরিণত হয়েছে।
সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, সিলেট মহানগরীর দীর্ঘদিনের সমস্যা নগরীর ফুটপাত ও রাস্তা দখলমুক্ত রাখা। হকাররা সব সময়ই কখনো রাজনৈতিক দলের, কখনো ব্যক্তির কিংবা কখনো গ্রুপ ভারী করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হকার পুনর্বাসনের উদ্যোগ ভালো।
কিন্তু তাদের জীবনমানের উন্নতি ও ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করাও সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। এ ব্যাপারে সর্বদলীয় ও সুশীল সমাজের সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। রাস্তা-ফুটপাত দখল করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি কোনো নাগরিক সমর্থন করে না। আমিও ব্যক্তিগতভাবে হকারমুক্ত নগরীর পক্ষে। এ ব্যাপারে স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করা সময়ের অপরিহার্য দাবি। একমাত্র জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। হকারদের কাছে থেকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রভাবশালী সুবিধা ভোগ করছেন। তাদের ছত্রচ্ছায়ায় হকাররা এত সাহস পাচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রাস্তা-ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় নগরীতে যানজটসহ নানা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা দেখেছি, পুনর্বাসনের নামে দলীয় কতিপয় নেতাকর্মীকে চাঁদাবাজির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
রাস্তা-ফুটপাত হকারমুক্ত করতে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। হকারদের ন্যায্য দাবি শুনতে হবে। তাহলে নগরের রাস্তা-ফুটপাত হকারমুক্ত করা সম্ভব।
এ ব্যাপারে হকার নেতা রুহুল আমীন রুবেল বলেন, লালদীঘির পাড় মাঠে ব্যবসার পরিবেশ ও শৃঙ্খলা নেই। আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি, ওই মাঠে ব্যবসার পরিবেশ ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে। মার্কেটের সামনের দিকে কাপড়চোপড় ও কসমেটিকের দোকান এবং শেষের দিকে মাছ ও তরকারির দোকানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে মার্কেটও জমে উঠবে। আমরাও চাই একটা জায়গায় বসে ব্যবসা করতে। নগরবাসীর দুর্ভোগ সৃষ্টি করা আমাদের কাম্য নয়।
এদিকে, নগরের রাস্তা-ফুটপাত হকারদের দখলে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী। সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানাসহ প্রধান প্রধান সড়কের দুই পাশ দখল করে রেখেছেন হকাররা। কাপড় ও জুতার দোকানিরা পসরা সাজিয়ে রেখেছেন সড়কের অর্ধেক অংশজুড়ে।
এ ছাড়া সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতারাও রয়েছেন সড়কের ওপর। প্রতিদিন বিকেল হতেই হকারদের উৎপাত বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা নামার আগেই সড়কের অর্ধেক হকারদের দখলে চলে যায়। কোনো কোনো দিন রাত ১২টার পরও রাস্তা দখল করে তারা ব্যবসা করেন।