ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০২৫

শেরপুরে আলুর বাম্পার ফলন: হিমাগার সংকটে বিপাকে কৃষক

শেরপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২৫, ০২:৪৫ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

এবার শেরপুরে আলুর বাম্পার ফলন হলেও হিমাগার সংকটের কারণে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। উৎপাদনের তুলনায় হিমাগারের ধারণক্ষমতা অত্যন্ত কম মাত্র ১৪ শতাংশ। ফলে সংরক্ষণের সুযোগ না পেয়ে চাষিরা বাধ্য হয়ে কম দামে আলু বিক্রি করছেন, যা তাদের জন্য বড় ধরনের লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাম্পার ফলন, কিন্তু সংরক্ষণের সুযোগ নেই। চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ফলনও হয়েছে চমৎকার।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর শেরপুরে ৯৫ হাজার ৭০৬  টন আলু উৎপাদিত হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। অথচ জেলার হিমাগারগুলোর মোট ধারণক্ষমতা মাত্র ১৩ হাজার টন।

শেরপুর সদর ও নকলা উপজেলায় বিএডিসির (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) দুটি সরকারি হিমাগার রয়েছে, যার সম্মিলিত ধারণক্ষমতা ৩ হাজার টন। তবে এগুলো শুধু চুক্তিবদ্ধ চাষিদের বীজ আলু সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়। জেলার একমাত্র বেসরকারি হিমাগার ‘তাজ কোল্ড স্টোরেজ’-এর ধারণক্ষমতা ১০ হাজার টন, যা ইতোমধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেছে।

ফলে হিমাগার সংকটে চাষিদের দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। মাঠ থেকে পুরোদমে আলু তোলা চলছে, কিন্তু ইতোমধ্যেই হিমাগারগুলো পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। বাধ্য হয়ে তারা আলু কম দামে বিক্রি করছেন, কারণ সংরক্ষণের সুযোগ নেই। পাইকারি বাজারে বর্তমানে আলুর দাম ২০-২২ টাকা কেজি, যা উৎপাদন খরচের তুলনায় কম।

শেরপুর সদর উপজেলার লছমনপুর ইউনিয়নের আলুচাষি মোঃ গোলাম মোস্তফা বলেন, "১৮ বিঘা জমিতে বীজ আলুর চাষ করেছি। আল্লাহর রহমতে ভালো ফলন হয়েছে। কিন্তু বিএডিসি শুধু নির্দিষ্ট মানের (গ্রেড এ ও বি) আলু নিচ্ছে, বাকিটা সংরক্ষণ করার জায়গা নেই। তাই কম দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে, এতে বড় লোকসান গুনতে হবে। যদি সরকার রপ্তানির উদ্যোগ নিত, তবে কৃষকদের অনেক সুবিধা হতো।"

আরেক চাষি মোঃ ইসমাইল হোসেন বলেন, "আমি বিএডিসির চুক্তিবদ্ধ চাষি হিসেবে ৩০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। বিএডিসি নির্দিষ্ট পরিমাণ আলু নেবে, কিন্তু বাকিটা হিমাগারে সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছিনা। আমার মতো আরও অনেকেই এই সংকটে পড়েছেন।"

হিমাগারে জায়গা না পেয়ে তাজ কোল্ডস্টোরেজের সামনে শত শত ট্রাক আলু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা-শেরপুর-শ্রীবরদী আঞ্চলিক মহাসড়কে। প্রায় দেড় কিলোমিটারজুড়ে অপেক্ষমাণ ট্রাকচালকরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। অনেকেই ৩-৪ দিন ধরে অপেক্ষা করছেন, তবুও আলু সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন না।

কৃষকরা কেউ কেউ অভিযোগ করে বলেন, "হিমাগার কর্তৃপক্ষ আগেই বেপারীদর কাছে জায়গা বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে। ফলে আমরা সংরক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। বীজ আলু সংরক্ষণ করতে না পারলে পরের বছর কিনে আবাদ করতে হবে।

তাজ কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, "আমরা আমাদের ধারণক্ষমতার শেষ ধাপে পৌঁছে গেছি। এখন মাত্র দেড় হাজার মেট্রিক টন আলু নেওয়া সম্ভব। ইতোমধ্যে শত শত ট্রাক অপেক্ষা করছে, কিন্তু আমরা সব আলু সংরক্ষণে নিতে পারব না। গত তিন দিন ধরে মাইকিং করে চাষিদের গাড়ি ফেরত নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সংরক্ষণের অনুরোধ জানাচ্ছি। কিন্তু অনেকেই সেটি মানছেন না, ফলে সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়েছে।"

শেরপুর জেলার পাঁচটি উপজেলায় এ বছর ৫ হাজার ২৯৬ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে, যার মধ্যে ৫২০ হেক্টর জমিতে বীজ আলুর চাষ হয়েছে। হিমাগার সংকটের কারণে কৃষকদের কম দামে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে চাষিদের নিরুৎসাহিত করতে পারে।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এতো বিপুল পরিমাণ আলু সংরক্ষণের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তা না হলে কৃষকদের লোকসান গুনতে হবে এবং ভবিষ্যতে আলু চাষে অনীহা দেখা দিতে পারে।