ঢাকা সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫

‘আমার বোরকা লাগতো নায়, বাবা তুমি ফিরে আও’

মতিউর রহমান মুন্না, নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) থেকে ফিরে
প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৫, ০৭:২১ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

‘আমার বোরকা লাগতো নায়, বাবা তুমি ফিরে আও, তোমারে আর কোন দিন বোরকার কথা কইতাম নায়, তুমি আইলেই অইবো।’ ৫ই আগষ্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণকারী আজমত আলীর স্কুল পড়ুয়া মেয়ে নাহিদা আক্তার এভাবেই সাংবাদিকদের কাছে বর্ণনা করতে গিয়ে বাবার স্মৃতি মনে করে বারবার কাঁদছেন।

৪ আগষ্ট তার বাবার সাথে সবশেষ মুঠোফোনে কথা হয়েছিল হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ ম্যাপল স্কুলের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী নাহিদা আক্তারের।

নাহিদা আক্তার জানান- ‘জীবিকার তাগিদে বিগত ৫ বছর ধরে তার পিতা আজমত আলী ঢাকায় বসবাস করে সেখানে মাছের ব্যবসা করেন। তিনি মাসে মাসে পরিবারের খরচ ও তাদের লেখা পড়ার খরচ পাঠাতেন। তা দিয়েই চলতো পরিবার।

তার বোরকা পুরাতন হয়ে যাওয়ায় তার পিতাকে নতুন একটি বোরকা কিনে দেয়ার আবদার জানিয়েছিল, তখন তার পিতা আজমত আলী ফোনে জানিয়েছিলেন ঢাকায় এখন আন্দোলন চলছে সব কিছু বন্ধ। তিনি বাড়িতে আসবেন নয়তো দোকানপাঠ খুললেই ১ সপ্তাহের মধ্যেই বিকাশে বোরকার টাকা পাঠিয়ে দিবেন। কিন্তু পরের দিনই তার মৃত্যুর খবর আসে।’

নিহত আজমত আলী হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ পৌর এলাকার হরিপুর গ্রামের মজর আলীর ছেলে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪এ শহীদদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। গত ১৫ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এটি প্রকাশ করেছে।

সরকারি এ গেজেট অনুযায়ী, ওই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদের সংখ্যা ৮৩৪। এর মধ্যে আজমত আলী রয়েছেন ৪৭৬ নম্বরে। গেজেট অনুযায়ী তার মেডিকেল কেস আইডি ২২৫৩৮।

আজমত আলীর পরিবারে রয়েছেন- তার দুই ছেলে মাহফুজ আলম মাহিদ (১৮), মাহিনুর আলম মাহিন (১২) ও এক মেয়ে নাদিয়া আক্তার (১৫) এবং অসুস্থ স্ত্রী রবিরুন বেগম।
সরেজমিনে নবীগঞ্জ পৌর এলাকায় গেলে স্থানীয়রা জানান, আজমত আলী স্থানীয় বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। অভাব অনটনে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হতো আজমত আলীর। তাই বিগত ৫ বছর পূর্বে জীবন জীবিকার তাগিদে আজমত আলী রাজধানী ঢাকায় চলে যান। সেখানে গিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় মাছের ব্যবসা করতেন।

ঢাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৫ই আগষ্ট ঢাকা যাত্রাবাড়ী এলাকায় মিছিলে যোগ দেন আজমত আলী। ওই সময় পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন আজমত আলী।

এই খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে কান্নার রুল পড়ে ওই পরিবারসহ গ্রামবাসীর মাঝে। অবুঝ সন্তানদের আহাজারিতে এলাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠে। সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন শহীদ আজমত আলীর স্ত্রী।

স্থানীয়রা জানান, অভাব অনটনের মাঝে ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে অতিকষ্টে জীবন যাপন করছেন আজমত আলীর স্ত্রী রবিরুন বেগম।

তারা এখনও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সহায়তা পাননি। পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করেন এলাকাবাসী।

নিহত আজমত আলীর অসুস্থ স্ত্রী রবিরুন বেগম জানান, তারা টিভিতে ও খবরের কাগজে দেখেছেন বিভিন্ন জায়গায় শহীদ পরিবারকে সরকারীভাবে সাহায্য করা হচ্ছে। কিন্তু তারা এখনো কিছু পাননি।

তবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এর পক্ষ থেকে আর্থিক ভাবে কিছু সহযোগিতা পেয়েছেন।

রবিরুন বেগম বলেন, ‘তার স্বামী শহীদ আজমত আলী ঘটনার আগের দিন (৪ঠা আগষ্ট) রাতে শেষবারের মতো ফোনে আলাপ হয়। প্রথমে তার মেয়ে নাদিয়া আক্তারের সাথে কথা বলেন। নাদিয়া আক্তার তার বাবা’র কাছে একটি বোরকা কথা বলে।

কিন্তু ৫ই আগষ্ট সোমবার বোরকার পরিবর্তে লাশ হয়ে ফিরলেন নাদিয়া আক্তারের বাবা আজমত আলী।’ এসব কথা বলে বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন রবিরুন বেগম।

রবিরুন বেগম আরো জানান, ‘ঢাকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ তাই তাকে সাবধানে থাকতে বলেছিলেন এবং কোন মিছিল ও আন্দোলনে যেতেও নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তা মানেন নি আজমত আলী। তার ভাষ্য - স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এখনই আন্দোলনের সময়।’

রবিরুন বেগম কাদঁতে কাদঁতে বলেন- তার স্বামী হিসেবে স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি খুবই দায়িত্বশীল ছিলেন। অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা পুড়ায়। যার কারনে ৫ বছর ধরে ঢাকায় মাছের ব্যবসা করতেন।

তার স্বপ্ন ছিল ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেলো।  অবুঝ মেয়েটি প্রতিনিয়তই তার বাবা’র কবরে পাশে গিয়ে কান্নাকাটি করে বলে, বাবা তুমি ফিরে এসো, আমার বোরকা লাগবে না। আমি কখনও তোমাকে বোরকার জন্য বলবো না বাবা।

শহীদ হওয়ার প্রায় ৭ মাস অতিবাহিত হলেও এখনও কান্না থামছে না ওই শহীদ পরিবারের। এলাকাবাসী অসহায় শহীদ আজমত আলীর পরিবারের পাশে দাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।

স্থানীয় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতা ইসলাম ইফতি বলেন- ‘শহীদ আজমতের পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্দ্যোগ নেয়া জরুরী। যেহেতু পরিবারের সদস্যরা ছোট তাই বাড়ির পাশে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা কোন খামার করে দেয়া যেতে পারে।

স্থানীয় নবীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছনি আহমেদ চৌধুরী বলেন- ‘যাত্রাবাড়ীতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আজমত আলী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়, শহীদ আজমত আলীর পরিবারের লোকজন অত্যান্ত মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করছে, গেজেট অনুযায়ী জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও কোন অনুদান পায়নি তার পরিবার।

দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি ভাবে তাদেরকে সহযোগিতা করার দাবী জানাই।’

এ ব্যাপারে জানতে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মোঃ রুহুল আমীনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘সরকারীভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে শহীদ আমজত আলীর নাম। সরকারী সহায়তার বিষয়টা প্রক্রিয়াধীন আছে।

ইতিমধ্যে আমরা শহীদ আমজত আলীর স্ত্রীর নামে সোনালি ব্যাংকে একটি একাউন্ট করিয়েছি এবং একাউন্টের তথ্য আমরা উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের বরাবরে প্রেরণ করেছি।

আশা করছি জুলাই বিপ্লবে শহীদ পরিবার খুব শীঘ্রই সরকারী অনুদান পাবে।’

ইউএনও রুহুল আমীন আরো জানান, ‘গত ৩ মার্চ তাদের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছি। রমজানে ইফতার সামগ্রী ক্রয় করার জন্য পৌরসভার ফান্ড থেকে ছোট একটা অনুদান প্রদান করেছি।

তার মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করা হবে।’

এদিকে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিরা মার্চ থেকেই ভাতা পাবেন। প্রেস সচিব জানান, ৯ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদরা ‘জুলাই শহীদ’ এবং আহতরা ‘জুলাই যোদ্ধা’ নামে অভিহিত হবেন। আর মার্চ থেকেই ভাতা পাবেন ‘জুলাই শহীদ পরিবার ও যোদ্ধারা।  

৮৩৪ জন জুলাই শহীদদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রতিটি জুলাই শহীদ পরিবার এককালীন ৩০ লাখ টাকা পাবেন। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা দেয়া হবে। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাকি ২০ লাখ টাকার জাতীয় সঞ্চয়পত্র দেয়া হবে।

এ ছাড়া শহীদ পরিবারকে প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা দেয়া হবে এবং শহীদ পরিবারের সক্ষম সদস্যরা সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবেন।
অপরদিকে জুলাই যোদ্ধরা তিনটি মেডিক্যাল ক্যাটাগরি: ক্যাটাগরি-এ, ক্যাটাগরি-বি এবং ক্যাটাগরি-সি অনুযায়ী সুবিধাদি পাবেন।