ঢাকা মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫

কাজে আসেনি ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প

চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২৫, ০৪:২৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

বর্ষা মৌসুমে পানি খালের মাধ্যমে নদীতে গিয়ে পড়বে। দূর হবে এলাকার জলাবদ্ধতা। আর শুষ্ক মৌসুমে খালে পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে ভূ–উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে। তাতে কৃষকেরা সেচ সুবিধা পাবেন। এতো সব উপকারিতার কথা তুলে ধরে খাল খনন করেছিলো বিএমডিএ।

কিন্তু দুই-তিন বছর অতিবাহিত না হতে সেই খালই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তিন উপজেলার কৃষকদের। তারা একই বর্ষা মৌসুমে জলবদ্ধতায় ভুগছেন ও শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার করছেন।

প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘রাজশাহী জেলার বাঘা, চারঘাট ও পবা উপজেলার জলাবদ্ধতা নিরসন এবং ভূ–উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ’। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যায় হয়েছে ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

এই প্রকল্পের আওতায় বাঘা উপজেলার মুর্শিদপুর থেকে নওটিকা পর্যন্ত ৮ দশমিক ২০ কিলোমিটার, চারঘাট উপজেলার মেরামতপুর কাঁকড়ামারী বিল থেকে পিরোজপুর পদ্মা নদী পর্যন্ত ২ দশমিক ১০ কিলোমিটার ও চারঘাটের ইউসুফপুর পদ্মা নদী থেকে পবা উপজেলার কাঁটাখালি হয়ে ছত্রগাছি  পর্যন্ত ১১ দশমিক ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়। ২০১৯ সালে ২৪ মে এই কাজের উদ্বোধন হয়ে খাল খনন কাজ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের শেষের দিকে।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্র জানা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় ২১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার খাল খনন, এক হাজার ৫৩৫ কিলোমিটার খালের পাড়ে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, খালের উপরে চারটি ফুট ওভার ব্রীজ, ২০টি সৌর চালিত পাতকুয়া ও ১০টি সৌর এলএলপি স্থাপন করা হয়। খালের পাশে রোপণ করা হয় ৮ হাজারটি ফলজ ও বনজ চারা। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিলো জলবদ্ধতা দূর করে ও সেচ সুবিধা নিশ্চিত করে এক হাজার ৬০০ হেক্টর জমি ফসলাদি চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসা।

তবে প্রকল্পের আওতায় থাকা তিন উপজেলার কৃষকেরা বলছেন, স্থানীয়ভাবে কোনো প্রকার জনমত জরিপ ছাড়াই কোটি কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বরং খাল খননে বাঁধা দিয়ে বাঘা ও চারঘাটের কৃষকেরা মামলা ও হামলার শিকারও হয়েছেন। এখন ভরাট হয়ে কোনো খাল দিয়েই বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহিত হয় না। পাশে খাল থাকা সত্ত্বেও শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

এ বিষয়ে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ বলছেন, এলাকায় জরিপ করেই এই প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদনের আগে এলাকার মানুষ জলাবদ্ধতায় তাদের দুর্ভোগের কথা বলেছেন। তাদের দুর্ভোগ লাঘবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

সরেজমিন চারঘাট উপজেলার মেরামতপুর কাঁকড়ামারী বিল-পিরোজপুর পদ্মা নদী খাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা নদীর অংশে খালের কোনো অস্তিত্ব নেই। সরু খাল খনন করে তার উপরে পাটাতন দিয়ে পিচঢালা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ড্রেণের মতো খালের ভেতরে ময়লা আবর্জনা ও মাটি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। বিন্দু পরিমাণ পানি চলাচলের কোনো উপায় নেই।

পিরোজপুর এলাকার কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, তৎকালীন ক্ষমতাসীন আ’লীগের নেতাকর্মীরা কালভার্টের মুখে পুকুর খনন করে পুরো কাঁকড়ামারী বিলে জলাবদ্ধতা তৈরি করেছিলো। সেই জলবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব আ’লীগের নেতাকর্মীদেরই দেওয়া হয়েছিলো। তারা ইচ্ছেমত কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে। আগে শুধু বিলে জলাবদ্ধতা ছিলো, খাল খননের পর বর্ষাকালে বসতবাড়িতেও জলাবদ্ধতা হয়। অথচ খাল খননের সময় মাস খানেক আগে নির্মাণ করা দেড় কোটি টাকার নতুন সড়ক নষ্ট করা হয়েছে।

বাঘা উপজেলার বাজু বাঘা ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, কোটি টাকার খালে কৃষকেরা বিন্দুমাত্র উপকৃত হয়নি। বরং বাগান-বাড়ি খাল খননে বিলীন হবার পাশাপাশি হামলা-মামলায় অনেকেই ঘর ছাড়া হয়েছেন। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি কিছু অংশে জমে থাকে, বছরের অধিকাংশ সময়ই থাকে পানিশূন্য। এ অবস্থায় যে যার মত খাল দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে কৃষকেরা ফসল আবাদ নিয়ে বিপাকে পড়ছেন।

এদিকে যে ২০টি সৌরচালিত পাতকুয়া স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো স্থাপন করা হয়েছে আ’লীগ নেতাকর্মীদের বাড়ির আনাচেকানাচে। অপারেটর হিসাবে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে তাদের। এ অবস্থায় পাতকুয়া থেকেও সঠিক ভাবে সেচ সুবিধা পাচ্ছেন না কৃষকেরা। খালের পাশে ৮ হাজারটি ফলজ ও বনজ চারা রোপণের কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো গাছের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

সুজন-সুশানের জন্য নাগরিক রাজশাহী জেলার সভাপতি সফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশেষজ্ঞদের মতামত কিংবা জনমত গুরুত্ব না দিয়ে তড়িঘড়ি করে প্রকল্প গুলো নেওয়া হয়েছে। প্রভাবশালীরা উপর মহল থেকে অর্থ ছাড় করিয়েছেন। বাস্তবে জনগণ কতটুকু উপকৃত হচ্ছে তা কেউ মূল্যায়ন করেনি। তদন্ত সাপেক্ষে এসব প্রকল্পের সাথে  জড়িত আমলা থেকে রাজনীতিবিদ যারাই অনিয়মের সাথে জড়িত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নাজিরুল ইসলাম ওই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা দূর করা ছিল প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। ওই সব এলাকায় জলাবদ্ধতা আর হয় না। কিন্তু কেউ প্রভাব খাঁটিয়ে খাল ভরাট করলে তা পরিস্কার করার দায়িত্ব আমার না। প্রকল্প শতভাগ কার্যকর হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।