কোনোকিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো। এ অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের মধ্যে চারটি ইজারার মাধ্যমে সীমিত আকারে চালু হয়েছে। বাকি পাঁচটি পাটকল বেসরকারিভাবে চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও আগ্রহী হচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। এ ছাড়া অন্যটির মালিকানা নিয়ে মামলা চলমান থাকায় সিদ্ধান্তহীনতা আর অনিশ্চয়তায় রয়েছে মিলটি। যা নিয়ে হতাশ ও ক্ষুব্ধ শ্রমিকসহ খুলনাবাসী।
বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আর্থিক ক্ষতির মুখে ২০২০ সালের জুলাইয়ে খুলনা অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে চাকরি হারান স্থায়ী-অস্থায়ী প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক। এরপর বিজেএমসি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) বন্ধ পাটকল চালুর পরিকল্পনা করে।
কিন্তু ব্যবসায়ীরা পিপিপিতে পাটকল চালাতে রাজি হননি। দীর্ঘমেয়াদি ইজারা চান তারা। পরে পাটকল চালুর পথ খুঁজতে কারিগরি কমিটি করা হয়। কারিগরি কমিটি স্বল্প সময়ের জন্য পাটকল ইজারা দিতে সুপারিশ করে। পরবর্তী সময়ে সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে পাটকলগুলোকে বেসরকারি খাতে ৫ থেকে ৩০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তারপর ইজারা দিতে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রথম আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রের শর্তে ছিল ইজারাদার শুধু পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন করতে পারবে। আর মেয়াদ হবে ২০ বছর। কিন্তু টেন্ডারে কেউ তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। পরে পাটজাত পণ্যের বাইরে টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদনের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া পাটকলগুলোকে বেসরকারি খাতে ৩০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০২২ ও ২০২৩ সালে বেসরকারি উদ্যোগে চালু হয় খুলনার দৌলতপুর, ইস্টার্ন এবং যশোরের জেজেআই ও কার্পেটিং জুট মিল। এর মধ্যে জেজেআই জুট মিল কিছুটা ভালোভাবে চললেও বাকি মিলগুলো উৎপাদন করছে সক্ষমতার এক-চতুর্থাংশ। সর্বসাকুল্যে চাকরি হয়েছে হাজার দুয়েক শ্রমিকের। যা নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টদের।
দৌলতপুর জুটমিলের প্রকল্প প্রধান তানজিলা মাহমুদা জানান, তার মিলে মোট ২৫০টি তাঁত রয়েছে, চালু করা হয়েছে ৩০টি। মিল বন্ধের আগে ৩ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন, এখন শ্রমিক কাজ করেন ছয়শ। বন্ধের আগে উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ টন। তবে এখন উৎপাদন হচ্ছে মাত্র দেড় টন। তিনি বলেন, আমাদের ইচ্ছা আছে, পর্যায়ক্রমে তাঁতের সংখ্যা বাড়ানোর। এই জুট মিল থেকে আমরা লাভের মুখ দেখব বলে আশা করি।
শ্রমিক নেতা খলিলুর রহমান বলেন, বেসরকারিভাবে পাটকলগুলো চালু হওয়ায় শ্রমিকদের কোনো লাভ হচ্ছে না। ইজারা নেওয়া নতুন মালিকপক্ষ যে চারটি মিল চালু করেছে তাতে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র দুই হাজার শ্রমিকের। অথচ একেকটি জুট মিলেই তিন হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করত। যেসব শ্রমিকের কাজ হয়েছে, তাদেরও বেতন দেওয়া হচ্ছে খুবই সামান্য। যদি বেসরকারিভাবে চালাতেই হয়, তাহলে শ্রমিকদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মিলগুলো চালাতে হবে।
অন্যদিকে, বাকি পাঁচটি পাটকলের মধ্যে খালিশপুর জুটমিল ইজারা নিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে রেডিয়েন্ট ফার্মাসিস্ট গ্রুপ। কিন্তু এখনো হস্তান্তর হয়নি। তবে ক্রিসেন্ট জুটমিল, স্টার জুটমিল ও প্লাটিনাম জুটমিল ইজারা নিতে আগ্রহীদের থেকে আন্তর্জাতিক আবেদন আহ্বান করেছে বিজেএমসি। শর্ত শিথিল করে বিভিন্ন মিলে ছয় থেকে সাত দফা টেন্ডার আহ্বান করা হলেও প্রত্যাশিত বিনিয়োগকারীদের খুব একটা সাড়া মিলছে না।
শ্রমিক নেতা দীন মোহাম্মদ বলেন, মিল যখন বন্ধ করা হয় তখন বলা হয়েছিল, এটা সাময়িক। তিন মাস পর সব মিল চালু হয়ে যাবে। কিন্তু প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল মিলগুলোর সেই একই অবস্থা। তিনি বলেন, খুলনা অঞ্চলের পাটকলগুলোর শ্রমিকরা অন্য কোনো কাজ শেখেনি। ফলে তাদের অনেকটা মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা নেওয়ায় আমাদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। তবে এখন মনে হচ্ছে, তারাও কোনো ভূমিকা রাখছে না। বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক সমন্বয় কর্মকর্তা গোলাম রাব্বানী বলেন, লিজ প্রক্রিয়ায় আমরা চারটি মিল চালু করেছি। এর মধ্যে জেজেআই খুব ভালোভাবে উৎপাদন করছে। অন্য তিনটি মিল খুব বেশি উৎপাদন না করলেও মিলগুলোকে উৎপাদনমুখী রেখেছে। এ ছাড়া বাকি মিল চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আমরা আশা করি, দ্রুত সব মিল চালু হয়ে যাবে। বেসরকারিভাবে চালু হওয়া মিলগুলো দ্রুত লাভের মুখ দেখবে।
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি উদ্যোগে চালু হওয়া খুলনার চারটি মিলের মধ্যে জেজেআই মিলে প্রতিদিন ৬০ টন পাট-পণ্য উৎপাদন হয়। বাকি তিনটি মিলে প্রতিদিন মোট উৎপাদন হয় ১২ টনের মতো।
তবে পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা বলেন, বিভিন্ন কোম্পানি মিল সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লোন নিচ্ছে। পরে সেই টাকা মেরে দিয়ে তাদের নিজস্ব জায়গায় স্থাপনা করেছে কিন্তু সরকারি জায়গায় কোনো স্থাপনাই করছে না। এ ছাড়া জুটমিলের কথা বলে ইজারা নেওয়া হলেও করছে অন্য ফ্যাক্টরি। এগুলো প্রহসন হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :