বুধবার, ০৯ এপ্রিল, ২০২৫
ফিল্মি স্টাইলে বোমা বিস্ফোরণ

জাজিরায় পুরুষশূন্য গ্রাম

শরীয়তপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৫, ১২:২৪ এএম

জাজিরায় পুরুষশূন্য গ্রাম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আধিপত্য বিস্তারের জেরে শরীয়তপুরের জাজিরায় দুই পক্ষের সংঘর্ষ এবং শতাধিক হাতবোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য গ্রাম। 

এ ঘটনার প্রধান আসামি কুদ্দুস ব্যাপারী ওরফে বোমা কুদ্দুসকে (৫৪) গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৮। গতকাল রোববার রাজধানীর শাজাহানপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

এর আগে ওই ঘটনায় জাজিরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সঞ্জয় কুমার দাস বাদী হয়ে বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা করেন। মামলায় ৮৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। 

গ্রেপ্তার কুদ্দুস ব্যাপারী বিলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর যৌথ বাহিনীর অভিযানে কুদ্দুস ব্যাপারী গ্রেপ্তার হন। কয়েক মাস কারাভোগের পর কিছুদিন আগে জামিনে মুক্তি পান তিনি।

জাজিরা থানার ওসি দুলাল আখন্দ এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বিলাসপুরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় ৮৮ জনকে আসামি করে আজ পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। 

এরই মধ্যে মামলার সাত আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে ইউপি চেয়ারম্যান কুদ্দুস ব্যাপারীকে গ্রেপ্তারের খবর পেয়েছি। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান।

গতকাল রোববার বিকেলে বরিশাল র‌্যাব-৮ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত প্রেস ব্রিফিংয়ে অধিনায়ক লে. কর্নেল নিস্তার আহমেদ বলেন, জাজিরার বিলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের গত নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জয়ী কুদ্দুস ব্যাপারী ও পরাজিত জলিল মাতবরের সমর্থকদের মধ্যে গত শনিবার সকালে সংঘর্ষ হয়। 

সংঘর্ষ চলাকালে কাজিয়ারচর গ্রামের জসিম ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ির সামনে উভয় পক্ষ বোমা নিয়ে একে অপরের ওপর নিক্ষেপ করে। 

এর কিছুক্ষণ পর মুলাই ব্যাপারীকান্দি গ্রামে ফসলের মাঠে পুনরায় উভয় গ্রুপ বালতিতে বোমা নিয়ে একে অপরের ওপর নিক্ষেপ করায় একজনের কবজি থেকে হাত বিচ্ছিন্ন হয় এবং উভয় পক্ষের ১৫ জন আহত হয়।

তিনি বলেন, পরে এর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় মামলা হলে গতকাল রোববার সকালে র‌্যাব-৮-এর মাদারীপুর ইউনিট এবং র‌্যাব-৩ যৌথ অভিযান চালিয়ে ঢাকার শাহজাহানপুরের মুমিনবাগ এলাকা থেকে বোমা কুদ্দুসকে গ্রেপ্তার করে। 

ওই নির্বাচনের পর থেকেই এ দুটি গ্রুপের সমর্থকেরা একাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে আসছে।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, কুদ্দুসের বিরুদ্ধে জাজিরা থানায় ১৯টি এবং ঢাকা মহানগরের বিমানবন্দর ও ভাটারা থানায় একটি করে মামলা রয়েছে। কিছুদিন আগে কুদ্দুস জেল থেকে বের হন। 

কারাগারে রয়েছেন জলিল মাতবর। এ ঘটনায় জাজিরা থানার পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। ওই মামলায় মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হলো।

বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি-মারধরের অভিযোগ: শরীয়তপুরের জাজিরায় মুহুর্মুহু হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সংঘর্ষের বিষয়ে সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়ায় এবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

গত শনিবার রাতে প্রতিপক্ষের সমর্থকদের বাড়িতে শতাধিক হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর পাশাপাশি চারজনকে মারধর করা হয়েছে বলেও দাবি ভুক্তভোগীদের। 

তবে পুলিশের দাবি, গ্রেপ্তারের ভয়ে এলাকা পুরুষশূন্য রয়েছে। এ অবস্থায় এমন হামলার সুযোগ নেই।

গতকাল সকালে বিলাসপুর ইউনিয়নের আহসান উল্লাহ মুন্সিকান্দি এলাকার ফেরদৌসি আকতার বলেন, ‘ঘটনার পর আমরা সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়ার কারণে রাতে জলিল মাদবরের সমর্থকেরা বাড়ি এসে শতাধিক বোমা ফাটিয়ে হুমকি দিয়ে গেছে। আমরা চরম আতঙ্কে আছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ এলাকায় ঢুকলে জলিলের সমর্থকেরা গা ঢাকা দেয়। পুলিশ চলে গেলে আবার এসে হুমকি দেয়। এটা পুলিশকে জানিয়েছি।’

স্থানীয় কাজিয়ার চর এলাকার আহাদ ইসলাম বলেন, ‘কথা বললেই যদি এমন হুমকির মুখে পড়তে হয়, তবে আমরা কীভাবে বাঁচব?’

নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক ভুক্তভোগী জানান, শনিবার রাতেই জলিল মাদবরের সমর্থকেরা মুলাই ব্যাপারীকান্দি, সলিমুল্লাহ মাদবরকান্দি ও আহসান উল্লাহ মুন্সিকান্দি এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেন। 

তারা শতাধিক বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে প্রতিপক্ষ আ. কুদ্দুস ব্যাপারীর চার সমর্থককে মারধর করে।

আহতরা হলেন আব্দুল হক মুন্সী, তার বড় ছেলে কুদ্দুস মুন্সী, নাতি শুভ মুন্সী এবং কাজিয়ার চর এলাকার ছাত্তার মুন্সী।

এ ব্যাপারে জাজিরা থানার ওসি মো. দুলাল আকন্দ বলেন, ‘ঘটনার পর এলাকায় অতিরিক্তি পুলিশ মোতায়েন আছে। শনিবার রাতে এলাকায় সেনাসদস্যসহ যৌথ অভিযান চালানো হয়েছে। 

‘গ্রেপ্তারের ভয়ে এলাকায় কোনো পুরুষ মানুষ নেই। তাই এমন হামলার কোনো সুযোগ নেই। মানুষই নেই, হামলা করবে কারা।’

এ বিষয়ে জানতে জলিল মাদবরকে একাধিকবার ফোন করলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায় এবং সমর্থক কাউকেই পাওয়া যায়নি।

স্থানীয়রা ও পুলিশ জানায়, বিলাশপুর ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বর্তমান চেয়ারম্যান আ. কুদ্দুস ব্যাপারী এবং পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী আ. জলিল মাদবরের মধ্যে বিরোধ চলছে। তারা দুজনই জাজিরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।

এই বিরোধের জের ধরে এলাকায় একাধিকবার সংঘর্ষে প্রাণহানিসহ শতাধিক আহতের ঘটনা ঘটেছে। উভয় গ্রুপের মধ্যে কয়েক ডজন মামলা বিচারাধীন।

 পরে শনিবার সকালে দূর্বাডাঙ্গা এলাকায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে পুনরায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় বাড়িঘর ভাঙচুরসহ পাঁচ শতাধিক হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। 

একপর্যায়ে মুলাই ব্যাপারীকান্দি, সলিমুল্লাহ মাদবরকান্দি ও আহসান উল্লাহ মুন্সিকান্দি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন। পরে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

দুই পক্ষের এই সংঘর্ষ ও হাতবোমা বিস্ফোরণের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে। 

১৫ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি খোলা মাঠে উভয় পক্ষের লোক মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। সেখানে হেলমেট পরিহিত অনেকের হাতে বালতি দেখা যায়। সেসব বালতি থেকে হাতবোমা নিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। হাতবোমাগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে মাঠজুড়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করছে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!