বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৫

বরিশালের তৃণমূলে পরিচ্ছন্ন নেতৃত্বের খোঁজে বিএনপি

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৫, ১০:৩৫ এএম

বরিশালের তৃণমূলে পরিচ্ছন্ন নেতৃত্বের খোঁজে বিএনপি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেশ কয়েকটি বিতর্কিত ঘটনায় জড়িয়ে লেজেগোবরে অবস্থা বরিশাল মহানগর বিএনপির। বিশেষ করে কতিপয় নেতাকর্মী এলাকাভিত্তিক নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের ধান্ধাবাজ কর্মীদের কূটকৌশলে পড়ে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করে। 

পাশাপাশি কারও কারও বিরুদ্ধে নিজ এলাকার লোকজনসহ নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে। এ নিয়ে বরিশালের রাজনৈতিক সমালোচকেরা যখন সরব, ঠিকই সেই মুহূর্তেই মহানগর বিএনপি ভবিষ্যতের ভাবনায় ওয়ার্ড পর্যায়ে সৎ, পরিচ্ছন্ন ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের উদোগ নিয়েছে। 

ইতিমধ্যে এমন চরিত্রের নেতাদের নাম-পরিচয় অনুসন্ধান করতে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক ও সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার তাদের কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যদের সমন্বয়ে বেশ কয়েকটি টিমও গঠন করেছেন।

মহানগর বিএনপি জানিয়েছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা এবং বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর তত্ত্বাবধানে বরিশাল নগরীর ত্রিশটি ওয়ার্ডে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের উদ্যোগ হিসেবে প্রাথমিকভাবে আটটি টিম গঠন করা হয়। 

প্রতিটি টিমে যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যসহ মোট পাঁচজন বরিশাল মহানগর বিএনপির পরিচিত মুখকে রাখা হয়েছে। এসব টিমের প্রধান এবং সদস্যদের দায়িত্ব হলো ওয়ার্ড পর্যায়ে ত্যাগী, সৎ ও পরিচ্ছন্ন নেতৃত্ব খুঁজে বের করা, সেক্ষেত্রে যারা ৫ আগস্ট পূর্বাপর কোনো রকমের অপকর্মে জড়িত নন, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

বরিশাল বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব মনিরুজ্জামান ফারুক ও সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন সিকদারের এই উদ্যোগকে কমিটির অপরাপর নেতাসহ ওয়ার্ডের কর্মীরা সাধুবাদ জানিয়েছেন। 

তবে কর্মী-সমর্থকদের অভিযোগ, নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের মতামত নেওয়া জরুরি, এর জন্য ওয়ার্ড পর্যায়ে কাউন্সিল করার গুরুত্ব রয়েছে। 

কিন্তু গত ১৭ বছরে কর্মী-সমর্থকদের মতামত উপেক্ষা করে ওয়ার্ড কমিটি গঠন করা হয়, তাতে অনেকে রয়েছেন, যারা স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য রেখে চলেছেন, ধান্ধা-বাণিজ্য করে অর্থ উপার্জন করার অভিযোগও কারও কারও বিরুদ্ধে আছে।

এই ধান্ধা-বাণিজ্য করে অর্থ কামাতে গিয়ে ৫ আগস্টের পরে বরিশালের একাধিক ওয়ার্ড বিএনপির নেতা মিডিয়ার শিরোনামও হয়েছেন। রাজনৈতিক সন্ত্রাসে জড়িয়ে কারও কারও পদ-পদবি হারানোর উদাহরণ রয়েছে। 

এসব বিতর্কিত নেতাকর্মীকে আগামীতেও যেন ওয়ার্ড কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে না আসা হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখার পরামর্শ দিয়েছে তৃণমূল বিএনপি। 

অবশ্য বরিশাল মহানগরের দূরদর্শী নেতৃত্বদ্বয় মনিরুজ্জামান ফারুক ও জিয়া উদ্দিন সিকদার ৫ আগস্টের পরে কর্মীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বদনামের আভাস পেয়েই ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। 

এবং তৎকালীন ঘোষণা দেওয়া হয়, পরবর্তীতে ওয়ার্ডভিত্তিক কাউন্সিল করে যোগ্য, দক্ষ, শিক্ষিত ও পরীক্ষিতদের সমন্বয়ে ওয়ার্ড কমিটিতে নেতা নির্বাচিত হবে। কিছুটা বিলম্বিত হলেও বরিশাল মহানগর বিএনপি তাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যা আসলেই প্রশংসার দাবি রাখে।

ত্রিশটি ওয়ার্ডের একাধিক কর্মী-সমর্থক অভিযোগ করেছেন, ৫ আগস্টের পরে তাদের কমিটির আহ্বায়ক-সদস্যসচিবেরা ন্যায়সংগত আচরণের অপেক্ষা বেশি মাত্রায় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে নিজেদের বিতর্কিত করে ফেলেছেন। 

তাছাড়া আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গ নিয়ে অর্থ বাণিজ্য করতে গিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি করেন। এক কথায় তাদের স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসরও বলা যায়, তাদের নেতৃত্ব আগামীতে তৃণমূল বিএনপি মেনে নেবে না। 

মূলত এ কারণেই কাউন্সিল করাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল এবং সেই ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছে মহানগর বিএনপি, যা বাস্তবায়ন করা গেলে শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি কর্মীদের মর্যাদা আরও বাড়বে।

ওয়ার্ড কমিটির নেতৃত্ব নির্বাচনের লক্ষ্যে আটটি টিম শনিবার গঠন করা হয়েছে উল্লেখ করে জিয়া সিকদারও তৃণমূলকে ইতিবাচক বার্তা দিতে চাইছেন। 

এই নেতা জানিয়েছেন, মহানগরের আওতাধীন ৩০টি ওয়ার্ড কমিটির নেতা নির্বাচনে টিমগুলো স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করবেন এবং তাদের দেওয়া তালিকা যাচাই-বাছাই করে পরবর্তীতে কাউন্সিলে কর্মী-সমর্থকদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে নেতৃত্ব চূড়ান্ত করা হবে। আশার কথা, এতে কোনো দ্বিমত বা অভ্যন্তরীণ বিরোধ থাকবে না। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ওয়ার্ডের কর্মী জানান, মনিরুজ্জামান ও জিয়া সিকদারের এমন লক্ষ্য-উদ্দেশ বাস্তবায়ন করা গেলে বরিশাল বিএনপিকে একটি পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব। 

নতুবা ফের লেজেগোবরে পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে, যেমনটি ৫ আগস্টের পরে কিছুটা আভাস পেয়ে শীর্ষ নেতাদের পরামর্শে কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। 

অবশ্য মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক হুঁশিয়ারি উচ্চরণ করে বলেছেন, বিএনপির পদ নিয়ে ধান্ধাবাজি ও অর্থকড়ি কামনোর প্রচেষ্টা রুখে দিতে হবে। শহিদ জিয়ার আদর্শ বিক্রি করে কেউ ফায়দা লুটেছেন বা লুটতে চাইছেন এমন কোনো নেতাকে ওয়ার্ড কমিটিতে নিয়ে আসার সুযোগ নেই। 

মূলত এর জন্যই কমিটিতে যোগ্য নেতৃত্ব চূড়ান্তকরণে আটটি টিম গঠন করা হয়েছে, যাদের দেওয়া তালিকা যাচাই-বাছাই করে কাউন্সিলের মাধ্যমে দায়িত্ব বণ্টন করা হবে।

তবে শনিবার সাংগঠনিক সভায় বরিশাল বিএনপি নেতাদের এমন উদ্যোগ একই কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিনকে হতাশ করেছে। 

এই নারী নেত্রী বিকেলের পরে ফেসবুক পোস্টে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন, মহানগর বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন কেন্দ্রীয় যুবদল নেতা হাসান মামুন, কিন্তু তিনি ওই সভায় অনুপস্থিত থেকেছেন, যা কর্মী-সমর্থকদের হতাশ করেছে। 

নাসরিনের দাবি, ওয়ার্ডের কমিটি গঠন করতে হলে সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির মাধ্যমে টিম গঠন করতে হবে। এর বাইরে নিয়মবহির্ভূতভাবে কিছু করা হলে তা কেউ মানবে না এবং তা প্রত্যাখ্যানও করা হবে। তাছাড়া শনিবার সাংগঠনিক সভা ও সিদ্ধান্তের বিষয়ে আগাম কিছু জানানো হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। 

ওয়ার্ড কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বরিশাল বিএনপির এই আয়োজনকে রাজনৈতিক বোদ্ধারা ব্যতিক্রম ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া হিসেবে অবহিত করলেও বলছেন, নারী নেত্রী নাসরিনের রাজনীতিতে অনেক ত্যাগ রয়েছে এবং তিনি একটি বড় অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন।

 তাকে উপেক্ষা করে নয়, বরং সবার ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত ও প্রচেষ্টায় কীভাবে ওয়ার্ডে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করা যায়, সেই পথে এগোতে হবে স্থানীয় বিএনপিকে। 

কারণ বিএনপি বৃহৎ রাজনৈতিক দল, এর ওয়ার্ড কমিটির নেতারা একটি বড় অংশের কর্মীদের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। সেই দায়িত্বশীল পদ দখল করে যদি নেতারা অপকর্ম করেন, সেই বদনাম বিএনপিকেই নিতে হবে। 

এসব চিন্তা-ভাবনা মাথায় রেখে টিমের প্রধানসহ সবাইকে নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে নেতৃত্ব নির্বাচনে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মন্তব্য পাওয়া যায়।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!