ঢাকা সোমবার, ০৭ এপ্রিল, ২০২৫

দেশে কেবলই কুতুবদিয়া চ্যানেলে ফেরি সার্ভিস চালু করার পালা

এস.কে. লিটন কুতুবী
প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৫, ০১:৩০ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নদী ও সাগর পথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহজ করার জন্য ফেরি সার্ভিস, সী ট্রাক সার্ভিস, ব্রিজ নির্মাণ, এমনকি টানেল তৈরি করে মূল ভূ-খণ্ডের মানুষের নাগরিক সুবিধা দিয়ে আসছে সরকার। নদী, হাওর, দুর্গম পাহাড়ি এলাকাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ দ্বীপে যোগাযোগের ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে দৃশ্যমান। দেশের মূল ভূ-খণ্ডের মানুষ পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পাঁচটি ভোগ করে যাচ্ছে সম্মিলিত জনগণ। কিন্তু এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত কেবল কুতুবদিয়া দ্বীপের দুই লক্ষাধিক মানুষ। যোগাযোগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল থেকে শুরু করে প্রত্যকটা জিনিসের দামের পাশাপাশি দ্বিগুণ টাকা গুনতে হচ্ছে। তার পাশাপাশি মানব পারাপারে থেমে নেই দুর্ভোগ।

বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ সূত্র জানা গেছে, সারা দেশে ৫০টির অধিক ফেরি রয়েছে। এগুলো বিভিন্ন নৌপথে যানবাহন পরিবহনে ব্যবহার হচ্ছে। যেমন যমুনা নদীতে আরিচা টু কাজিরহাট নৌপথে, পাটুরিয়া টু দৌলদিয়া নৌপথে, বাশঁবারিয়া টু সন্দ্বীপ নৌপথে, কর্ণফুলী নদীতে কালুঘাট টু বোয়ালখালী, কাপ্তাই চন্দ্রঘোনা দোভাষী বাজার ফেরি সার্ভিস। এক সময়ে পদ্মা নদী পারাপারে মাওয়া টু জাজিরা নৌপথে ১৫টির অধিক ফেরি চলাচল করত। পদ্মা সেতু হওয়ায় বর্তমানে ফেরি চলাচল বন্ধ। তবে দেশের অধিকাংশ নদীর ওপর সেতু বা ব্রিজ হয়ে যাওয়ায় এসব ফেরি বিভিন্ন ফেরিঘাটে অবস্থান করছে।

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কোস্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, দূর-দূরান্ত থেকে গাড়িযোগে মগনামা ঘাটে এসে উঠতে হয় ডেনিস বোট বা স্পিড বোটে, কুতুবদিয়া চ্যানেল পাড়ি দিয়ে কুতুবদিয়ার ঘাটে গিয়ে উঠতে হয়। তবে দুই উপকূলে গুনতে হয় হেঁটে যাওয়ার পথে টোল। আরিচা টু কাজিরহাট, পাটুরিয়া টু দৌলদিয়া ফেরি পারাপারে টোল আদায় হয় যেকোনো এক ঘাটে। কিন্তু কুতুবদিয়াবাসীর গুনতে হয় দুই পাশে।

এ জন্যই কুতুবদিয়া চ্যানেলে ফেরি সার্ভিস আবশ্যকীয় মনে করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও কুতুবদিয়া মহেশখালী আসনের সাবেক সাংসদ ডক্টর এএইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ কুতুবদিয়া। বঙ্গোপসাগরে বুকে পাঁচশ বছর পূর্বে জেগে উঠা চরের নামকরণ করা হয় কুতুবদিয়া দ্বীপ। সেই সময় থেকে জনবসতি গড়ে উঠে এ দ্বীপে। তখন থেকেই এ পর্যন্ত ধারাবাহিকতায় চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে দ্বীপে বসবাসরত জনগোষ্টি কুতুবদিয়া চ্যানেল পাড়ি দিয়ে মূল ভূ-খন্ডের সাথে দৈনিক যোগাযোগ করে আসছে। সেই সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কুতুবদিয়া দ্বীপ থেকে পারাপারের জন্য দৃশ্যমান পাঁচটি জেটি ঘাট নির্মাণ করেছে সরকার। গত মার্চ মাসে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায় নাগরিকদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য  সীতাকুন্ডু বাঁশবারিয়া ঘাট হতে ১৭ কিলোমিটার দুরত্ব সন্দ্বীপ চ্যানেলে ফেরী সার্ভিস চালু করেছে সরকার। কুতুবদিয়া চ্যানেলে পারাপার দুরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটার।

ফেরী সার্ভিস চালুর দাবীতে কুতুবদিয়া মহেশখালী আসনের সাবেক সাংসদ ও সাবেক কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান,কক্সবাজার জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি এটিএম নুরুল বশর চৌধুরী বলেন, পারাপারে জেটি ঘাট ব্যবহার করে দৈনিক পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী মানুষ। কুতুবদিয়া চ্যানেল দিয়ে (কুতুবদিয়া হতে) পেকুয়ার মগনামা, উজানটিয়া, বাঁশখালীর ছনুয়া,মহেশখালীর মাতারবাড়ি যাতাযাতের জন্য ব্যবহার করে থাকে ডেনিস বোট, স্পিড বোট। আবার মালামাল আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে কুতুবদিয়া চ্যানেল হয়ে বড় বড় মালবাহি ট্রলার দেশের বিভিন্ন স্থল বন্দরসহ  চট্টগ্রাম, কক্সবাজার চলাচল করে থাকে। 

কুতুবদিয়া দ্বীপের প্রবীণ রাজনীতিবিদ সাবেক কৈয়ারবিল ইউপির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, কুতুবদিয়া দ্বীপের জন্য কঠিন বিষয় ছিল বিদ্যুৎ । তাও সাব-মেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাপ্লাই দিয়ে দ্বীপ আলোকিত হয়েছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দ্বীপের মানুষের একটাই দাবী পারাপারে ফেরী সার্ভিস চালু করা। কুতুবদিয়া চ্যানেল সাড়ে তিন কিলোমিটার। এ চ্যানেলে ফেরী সার্ভিস চালু হলে নিরাপদ যাত্রী পারাপার, নিত্যপ্রযোজনীয়  মালামাল পরিবহনে আনা নেওয়া, ভ্রমন প্রিয়সী পর্যটকদের নিরাপদ ও বিনোদন স্পট হিসেবে উপভোগ করবে।

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কুতুবদিয়া আদালতের আইনজীবি ও কুতুবদিয়া উপজেলা প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা মোঃ আইয়ুব হোছাইন বলেন, কুতুবদিয়া দ্বীপে যোগাযোগের মাধ্যম পিছিয়ে থাকায় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সর্বস্থরের জনগণ। সরকার কৃত্রিমভাবে দ্বীপের মানুষের উপর হয়রানিমুলক কর বসিয়ে পায়ে হেঁটে গেলেই টোল দিতে হচ্ছে। জেটি বা ঘাট পারাপারে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে কুতুবদিয়া দ্বীপের মানুষ। কুতুবদিয়া দ্বীপ হতে বের হলেই জেটিতে পায়ে হেঁটে গেলেই পাঁচ টাকা আবার মগনামা জেটিতে উঠে পায়ে হেঁটে গেলেই পাঁচ টাকা টোল গুনতে হয়। প্রশ্ন উঠে কেন ? পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে টোল আদায় করতে হয় শুধু কুতুবদিয়া দ্বীপের মানুষের। মগের মুল্লুক! দেশের বিভিন্ন নদীর উপর সেতু ও নদীর নিচ দিয়ে টানেলে টোল আদায় করে থাকে শুধু যানবাহনের। মানব সম্পদের উপর টোল আদায় করতে দেখিনি পৃথিবীর কোন দেশে।  কিন্তু কুতুবদিয়া দ্বীপের মানুষের ক্ষেত্রে দু’পাশে পায়ে হেঁটে গেলেই গুনতে হয় টোল।

কুতুবদিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ জহিরুল ইসলাম ও কবি জসিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনিছুর রহমান বলেন, কুতুবদিয়া দ্বীপের জনগণ পারাপারে জন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি জেটি নির্মাণ করা হয়। এসব জেটি দিয়ে পারাপারের জন্য ব্যবহৃত যানবাহনের মানসম্মত নয়। বর্তমান সময়ের জন্য আধুনিক যান্ত্রিক বোটের ব্যবস্থা,সী ট্রাক,ফেরী সার্ভিস চালুর দাবী তুলেন তিনি।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি কুতুবদিয়ার সন্তান ফরিদুল আলম বলেন, জন্ম থেকেই জ্বলছি আমরা কুতুবদিয়া দ্বীপের মানুষ। সরকার জেটি ঘাট আর কুতুবদিয়া চ্যানেল পারাপার ইজারা দিয়ে থাকে। এক শ্রেণীর লোক ইজারা নেয়ার সময় দরপত্রে প্রতিযোগিতা দিয়ে ইজারা নেয়ার জন্য আকাশ চুম্বি মূল্যে দরপত্র জমা করে। তারপর এ দরপত্রের টাকা আদায় করতে সাধারণ মানুষের উপর চড়া মূল্যে টোল আদায় করতে স্টিম রোলার চালায়।

কুতুবদিয়া উপজেলা প্রশাসনের একজন নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)বলেন,পদ্মা সেতু হওয়ার পর মাওয়া টু জাজিরা নৌপথে চলাচল ফেরীগুলো এমনিতে পড়ে আছে। অবহেলিত কুতুবদিয়া দ্বীপের দুই লক্ষ মানুষের জন্য কুতুবদিয়া চ্যানেল পারাপারে যদি ফেরী সার্ভিস চালু করা হয় তাহলে মানুষের জীবন যাত্রার মান অনেক গুনে উন্নতি হতো। তার পাশাপাশি,লবণ, সামুদ্রিক মাছ, নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহন, পর্যটন খাতে সরকার অর্থনৈতিক অনেকগুণ লাভের মুখ দেখতো।