ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

সাতক্ষীরায় খাওয়ার পানি সংকটে ২২ লাখ মানুষ

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: এপ্রিল ১২, ২০২৫, ০১:৩৬ পিএম
বিক্রির জন্য বোতলে পানি ভর্তি করতেছেন দোকানদার, ছবি-রূপালী বাংলাদেশ

চারদিকে পানি থাকা সত্ত্বেও সাতক্ষীরা জেলার ২২ লাখ মানুষ তীব্র খাওয়ার পানি সংকটে ভুগছে। জীবনধারণ করতে আর্সেনিক, আয়রন ও লবণযুক্ত পানি পান করছেন এসব মানুষজন। এ ছাড়া উচ্চ বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ কোম্পানির বোতলজাত পানির প্রতি নির্ভর হয়ে পড়ছেন। এতে তাদের ব্যয়ও বাড়ছে।

সাতক্ষীরার দুটি পৌরসভাসহ জেলার সাতটি উপজেলাতেই কমপক্ষে ২২ লাখ মানুষ তীব্র খাওয়ার পানি সংকটে রয়েছে। উপজেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুপেয় পানির সংকট রয়েছে উপকূলীয় চার উপজেলা। তা হচ্ছে শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা।

স্বাস্থ্য বা মেডিসিন বিষেশজ্ঞদের অভিমত, নিয়মিত আর্সেনিক, আয়রন ও লবণযুক্ত পানি পান করলে মানুষের লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

অপরদিকে, জেলায় বিশুদ্ধ পানির অভাবের কারণে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো নজরদারি না থাকার সুবাদে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির অবৈধ পানি ব্যবসায়ীরা ব্যাঙের ছাতার মতো কোনো অনুমোদন ছাড়াই সাতক্ষীরা জেলার প্রায় জায়গায় গড়ে তুলেছেন পানির  নিম্নমানের প্লান্ট। অভিযোগ উঠেছে এসব পানি ব্যবসায়ীরা পানি ভালো করার নামে পানিতে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করে নিম্নমানের এসব  প্লান্ট  থেকে পানি বাহির করে। কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই এলাকায় ভ্যানে বা গাড়িতে করে এলাকার বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়। না বুঝেই এলাকার সহজ সরল মানুষ এসব  পানি পান করে গ্যাস্ট্রিক আলসার ও কিডনি রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

উপকুলীয় শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের ধুমঘাট গ্রামের গৃহবধু অঞ্জলি রানী (৩৫) ও মিনতি রানী (৩২) জানান, তাদের গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের মানুষের মধ্যে সুপেয় পানির সংকট তীব্র। গ্রামের অধিকাংশ নারী অনেক পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করেন।

শুধু ধুমঘাট নয়, পার্শ্ববর্তী জেলেখালী, মুন্সীগঞ্জ, যতিন্দ্রনগর, ভইরবনগর, আড়পাংশি ও হরিনগরসহ বহু গ্রামের মানুষ সুপেয় পানির কষ্টে রয়েছে।

আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া (একশোরা) গ্রামের কৃষি শ্রমিক মোমিন আলী ও আবু তালেব জানান, গ্রামের সব টিউবয়েলের পানিতে পর্যাপ্ত লবণ। জীবনধারণ করতে তারা লবণ পানি পান করেন। তবে বর্ষা মৌসুমে এলাকার পুকুর বা অন্যান্য জলাশয় থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে পারেন। শুষ্ক মৌসুমে খাওয়ার পানি সংকটে পড়েন।

তালা উপজেলার পাটকেলঘাটার স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল মতিন বলেন, আমাদের এলাকায় পানির লবণাক্ততা,  আয়রন ও অতিমাত্রায় আর্সেনিকের কারণে বোতলজাত পানিতে নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হচ্ছে। এতে আমরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। আবার অনেকেই বোতলজাত পানি কেনার সক্ষমতা না থাকায় তারা জেনে শুনে আয়রন, লবণাক্ত ও আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র মেডিসিন বিষেশজ্ঞ ডাক্তার মানস কুমার মন্ডল জানান, আর্সেনিক, আয়রন ও লবণযুক্ত পানি নিয়মিত পান করা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে লিভার ও কিডনি আক্রান্তের পাশাপাশি ক্যানসারও হতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের চর্মরোর্গের পাশাপাশি পেটের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। সুস্থ থাকতে হলে পানি বিশুদ্ধ করা বা ফুটিয়ে পান করার কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি এবিএম শফিুকুল ইসলাম জানান, সাতক্ষীরা জেলাতে কমপক্ষে ২২ লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে আছে। এখানে শতভাগ নলকূপ বা টিউবয়েলের পানিতে আছে আয়রণ, আর্সেনিক এবং লবণ। যা মানুষের খাওয়ার উপযোগী নয়।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় পানি কমিটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে সরকারিভাবে পর্যাপ্ত পানি শোধনাগার স্থাপন করা, পুকুর খননের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং গভীর নলকূপ স্থাপন করা। এ ছাড়া ভূগর্ভের পানি অপচয় রোধ করা।

তিনি আরও বলেন, একজন কৃষকের বোরো চাষের জন্য যে পরিমাণ পানির চাহিদা থাকে তার তিনগুণ পানি উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভস্থ থেকে। ফলে পানির স্তর দিনকে দিন নিচে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় পানি কমিটির এসব সুপারিশগুলো উত্থাপন করার পরও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ জানান, জেলার উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে রয়েছে পানিতে অতিমাত্রায় লবণ এবং সদর, কলারোয়া ও তালার টিউবয়েলগুলোতে পর্যাপ্ত আর্সেনিক ও আয়রন। ফলে মানুষের বোতলজাত পানি ক্রয় ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকছে না। তবে বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষ। যেখানে তারা সংসার চালাতে করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে পানি কিনে খাবে কীভাবে? ফলে বাধ্য হয়ে লবণ বা আর্সেনিক ও আয়রনযুক্ত পানি পান করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহিম তৈমুর জানান, দুই তিন দিন আগে সাতক্ষীরায় যোগদান করেছেন। এ জেলা সম্পর্কে তিনি এখনো অবগত নন। পরবর্তীতে খোঁজ-খবর নিয়ে জানাবেন।