মেলা এক গ্রামীণ সংস্কৃতি, যার প্রচলন শুরু হয়েছে বহু বছর আগে থেকেই। তেমনি একটি মেলা যার নাম বারুহাস মেলা। যেটি শুরু হয়েছে প্রায় দেড়শ বছর আগে, আর জমিদার আমল থেকেই গড়ে উঠেছে চলনবিলের ঐতিহ্যবাহী এই বারুহাস মেলা।
মেলার আয়োজক সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর চৈত্র চন্দ্রিমার ১৩ তারিখে চলনবিল অধ্যুষিত তাড়াশ উপজেলা সদর থেকে ১৬ কি. পশ্চিমে বারুহাস বাজার চত্বরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
সেই মোতাবেক এ বছরের মেলা শনিবার (১২ এপ্রিল) শুরু হয়। যদিও গতকাল বিকেল থেকেই শুরু হয়েছে মেলা। তবে মূল মেলার পরের দিন রোববার অনুষ্ঠিত হয় ‘বউমেলা’। যে মেলাতে আশপাশের গ্রামের বউরা তাদের প্রয়োজনীয় জিসিনপত্র কেনাকাটা করে।
মেলা উপলক্ষে ঝি জামাই বাড়িতে আনতেই হবে এমন রেওয়াজ বহুদিন থেকে চলে আসছে এই এলাকার মানুষের মধ্যে। স্থানীয়রা বারুহাস মেলার উৎসবকে সম্প্রতির মিলন মেলা হিসাবেই মনে করে।
স্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৭০ দশক থেকে ৯০ দশক সময়েও এ মেলার সুনাম ছিল উত্তরবঙ্গজুড়ে। অনেক দূর-দূরান্তের মানুষ মেলায় আসত। বগুড়া, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর ও পাবনাসহ দূর-দূরান্তের জেলা থেকে শৌখিন দর্শনার্থীরা মহিষ ও গরুর গাড়ির বহর নিয়ে মেলায় আসতেন। মেলার এক পাশে তাঁবু টানিয়ে করতেন মেলার কেনাকাটা।
সে সময় মূলত বারুহাস মেলা ছিল ২৫ থেক ৩০ গ্রামের মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসব। মেলার ১ মাস আগে থেকেই চলত নানা প্রস্তুতি। বাড়িতে কুটুমকে দাওয়াত করা, ঝি জামাই আনা, বাড়ি পরিষ্কার, মুড়ি ভাজাসহ যাবতীয় কাজ করার জন্য প্রায় ১ মাস আগ থেকেই বাড়ির লোকজন বিশেষ করে মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
মেলা উপলক্ষে জামাইদের উপঢোকন বা পরবি দেওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে সেই প্রথম থেকেই। জামাইরাও তাদের সাধ্যমতো বড় মাছ, মাংস ও মিষ্টি কিনে শ্বশুর বাড়িতে ফিরতেন।
বর্তমানে এ মেলার জৌলুস একেবারেই কমে গেছে। এক সময় বারুহাস মেলা ছিল ২০ থেকে ৩০ গ্রামের মানুষের প্রাণের উৎসব। এখন সেই মেলার উৎসব বলতে গেলে শুধু বারুহাস গ্রামকেন্দ্রিক হয়ে গেছে।
মেলার জৌলুস কমে যাওয়ার কারণের মধ্যে রয়েছে- মেলার নির্ধারিত জায়গা সংকট, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, মানুষের মানুষিকতার পরিবর্তনসহ সহজলভ্য বাজার ব্যবস্থা। এখন হাতের নাগালেই বড় বড় বাজার শপিংমল। যেখানে দেশ-বিদেশের আকর্ষণীয় পণ্যসামগ্রী সাজিয়ে রাখা হয় ক্রেতাদের জন্য।
এ অবস্থা চলতে থাকলে গ্রামীণ জীবনের এই লোকজ সংস্কৃতি যা আমাদের দেশের নিজস্ব সম্পদ, একসসয় হারিয়ে যাবে। যেমনিভাবে হারিয়ে যাচ্ছে দেড়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই বারুহাস মেলা। এভাবে চলতে থাকলে গ্রামীণ ঐতিহ্য মেলার স্থান হবে জাদুঘরে। তাই এটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এলাকাবাসীর দাবি জানিয়েছে।