ছোট্ট একতলা বাড়িতে জায়গা হচ্ছে না মানুষের। আকরামের মৃত্যুর খবর পেয়ে স্বজনরা ভিড় করেছেন। বিছানায় শুয়ে বিলাপ করছেন মা মবিনা বেগম। তার কান্না থামছেই না।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) বিকেলে খবর আসে আকরাম আর নেই। প্রাণ হারিয়েছেন চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে। এরপর থেকেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন সন্তান হারানোর শোকে কাতর মবিনা।
শনিবার (১৯ এপ্রিল) দুপুরে সরেজমিন আকরামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটু পর পর বিছানা থেকে উঠে আদরের সন্তানের কথা মনে করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন এই নারী।
গত ১৩ এপ্রিল মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে আকরামের শেষ কথোপকথন হয়, ‘আইচ্ছা আম্মা ভালো থাইকো, পরে আবার ফোন দিমুনে। আছি ভালোই। কিন্তু যেখানে কাজ করি, একটু আতঙ্কের মধ্যে থাকন লাগে। ড্রোন আসে তো! এগুলা দেখে চলাফেরা করন লাগে।’
এরপর টানা পাঁচদিন ধরে সন্তানের ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন মা মবিনা। কিন্তু ছেলের ফোন আর আসেনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের মোরশেদ মিয়া ও মবিনা বেগম দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় আকরাম মিয়া (২২)। মোরশেদ মিয়া পেশায় একজন কৃষক। আর কৃষক বাবার পক্ষে একা সংসার চালানো কষ্ট হচ্ছিল। তাই পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতেই রাশিয়ায় পাড়ি জমান এই তরুণ। কিন্তু স্বপ্ন অবশেষে ‘লাশ’ হলো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাবার কষ্ট দূর করতে নরসিংদীর পলাশ উপজেলার আমতলা এলাকায় অবস্থিত ‘এম. সোলাইমান টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার’ নামে একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখে গত ৯ মাস আগে পাড়ি জমান রাশিয়ায়। এ জন্য ধারদেনাও করেছিলেন প্রায় ১০ লাখ টাকা। সেখানে গিয়ে একটি চীনা কোম্পানিতে কাজ পান। এরপর সংসারে আসতে শুরু করে সচ্ছলতা। তবে আকরামের পরিবারের সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
পরিবারের অভিযোগ, মাত্র চার মাস কাজ করার পর বেতন বন্ধ করে দেয় চীনা প্রতিষ্ঠানটি। এরপর বেশ কিছু দিন বিনা বেতনে কাজ করিয়ে আকরামকে বিক্রি করে দেয় রুশ বাহিনীর কাছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুশ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে নামেন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে। প্রথম প্রথম কষ্টের কথা জানালেও পরে পরিবারের কষ্টের কথা ভেবে আকরাম মেনে নেন যুদ্ধজীবন। প্রায় আড়াই মাস রণাঙ্গনে কাটানোর পর গত ১৪ এপ্রিল প্রাণ হারান আকরাম।
আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাফে মোহাম্মদ বলেন, ‘আকরামের মরদেহ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে এরই মধ্যে পররাষ্ট্র এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। মরদেহটি এখন কোন স্থানে এবং কার হেফাজতে আছে- সে বিষয়ে তথ্য নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মন্ত্রণালয়ে যেতে বলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সব ধরনের সহযোগিতা দেবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে নিহতের পরিবারকে উপজেলা প্রশাসন থেকেও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :