ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫

পেঁয়াজ বীজ চাষে কোটিপতি সাহিদা

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৫, ১১:০৫ এএম
ছবি: সংগৃহীত

দেড়যুগ ধরে চাষ করছেন পেঁয়াজ বীজ। পেঁয়াজ ও পেঁয়াজ বীজ চাষ করে পেয়েছেন বহু পুরস্কার। হয়েছেন দেশের সেরা নারী কৃষক। বীজ বিক্রি করে আয় করেছেন কোটি কোটি টাকা। তিনি হচ্ছেন গৃহিণী থেকে দেশসেরা কৃষক হওয়া ফরিদপুরের পেঁয়াজ বীজ চাষি শাহিদা বেগম। 

পেঁয়াজের বীজ চাষ করে আত্মনির্ভরশীল তো বটেই বরং অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন সাহিদা বেগম। ২০২০ সালে সেরা নারী কৃষক হিসেবে পেয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড চ্যানেল আই এগ্রো অ্যাওয়ার্ড। ফরিদপুর কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনকারী কৃষকদের তালিকায়ও তিনি সেরা। 

এ ছাড়াও এরই মাঝে তিনি ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (বিএডিসি) চুক্তিবদ্ধ কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। চলতি বছর তিনি পেঁয়াজের বীজ বিক্রি করেছেন কমপক্ষে চার কোটি টাকার। উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে সাহিদা বেগমের আয় হয়েছে তিন কোটি টাকার মতো। 

সাহিদা জানান, ‘পেঁয়াজের সাদা কদম শুকিয়ে গেলে ঝরে পড়ে কালো দানা কিংবা বা বীজ। এ বীজের দাম অনেক। ফুলগুলো বড় করতে হয় অনেক ধৈর্য নিয়ে।’ তিনি জানান, মাঠ থেকে তুলে নিয়ে শুকিয়ে মলন দিয়ে বের করতে হয় সেই কালো সোনা। এ কাজে ঝুঁকি অনেক। কারণ, কয়েক মাস ধরে মাঠে বড় করতে হয়। বৃষ্টিপাত, গরম—সবকিছু প্রভাব ফেলে উৎপাদনে। যদিও এখানে যত ঝুঁকি, তত লাভ।

সূত্র জানায়, ফরিদপুর জেলায় চলতি বছরে ১ হাজার ৭১১ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজ আবাদ করা হয়েছে। যা থেকে ১ হাজার ২৬ টন বীজ উৎপাদিত হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যার মধ্যে দেশের মোট চাহিদার পেঁয়াজ বীজের ৪ ভাগের ১ ভাগ বীজ আসে শাহিদা বেগমের উৎপাদিত খান বীজ থেকে। স্থানীয় কৃষক তো বটেই, পুরো দেশের চাষি তার বীজ সরবরাহ করে থাকেন। তার বীজ ভালো বলে চাহিদা থাকে। কৃষকরাও অনেক খুশি।

শাহিদা বেগমের পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের কাজে সহায়তা করেন তার স্বামী বক্তার উদ্দিন খান। তিনি পেশায় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। চাকরি করেন সোনালী ব্যাংকে। শাহিদা বেগম গড়ে তুলেছেন পেঁয়াজ বীজের কারখানা। সেখান থেকেই বীজ প্যাকেটজাত করে ক্রেতার কাছে সরবরাহ করা হয়। তার তৈরি করা বীজ ক্রেতার কাছে পরিচিত ‘খান বীজ’ নামে। তার উৎপাদিত পেঁয়াজ বীজ হলো- তাহেরপুরী, সুখ সাগর, নাসিক কিং, বারী-১, বারী-৪, বারী-৫।

এলাকার কৃষক আলমাছ সেখ বলেন, ‘আমরা আগে অন্য ফসল চাষ করতাম; এখন পেঁয়াজ বীজ চাষ করি। কারণ শাহিদা বেগম যেভাবে এলাকায় পেঁয়াজ চাষ করছেন, সেটা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের এই চাষে আসা। এখন ভালো লাভ পাচ্ছি। দিন দিন চাষের এলাকা বাড়ছে।’

সুমন জোমাদ্দার বলেন, ‘শাহিদা বেগম শুধু পরিবর্তন করেননি। পেঁয়াজ চাষে তার সফলতা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তার দেখাদেখি এখন অনেক জমিতে পেঁয়াজ ও পেঁয়াজ বীজের চাষ শুরু করেছি। এখন আমার বাড়িতে বিল্ডিং হয়েছে। এভাবে যদি চাষ করতে পারি, তাহলে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি থাকবে না দেশে।’

মানিকগঞ্জ থেকে আসা বীজ ব্যবসায়ী রইচ মেম্বার বলেন, ‘আমি এ বীজের ব্যবসা করছি অনেক বছর। ফরিদপুর থেকেই বীজ কিনে নিয়ে ব্যবসা করি। তখন এমন বিপ্লব দেখিনি। শাহিদা বেগম বীজ চাষে আসার পর থেকে এই চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। একজন নারী পেঁয়াজ বীজ চাষি একশ থেকে দেড়শ বিঘা জমিতে চাষ করছেন, যা সারা দেশ তো বটেই; বিশ্বের কোথাও নেই।’

শাহিদা বেগম বলেন, ‘কৃষক পরিবারের বউ হওয়ায় আগে থেকেই নানা কৃষিকাজের সাথে পরিচয় ছিল। আমার শ্বশুর মূলত পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে আগ্রহী ছিলেন। আমার মনে হলো করে দেখি, তাই করলাম। ২০০৪ সালে দ্বিতীয় সন্তান জন্মের আগে ২০ শতক জমিতে পেঁয়াজের বীজ চাষ করি। সে বছর মাত্র দুই মণ বীজ হয়েছিল। সেগুলো বিক্রি করে পেয়েছিলাম ৮০ হাজার টাকা।’

তিনি আরও বলেন, ‘এভাবে বীজ বিক্রি করে দেখলাম যে, আমি ভালোই লাভবান। আস্তে আস্তে জমি বাড়াই। এভাবেই আমার ওঠা। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। গত বছর ৩০ একর জমিতে চাষ করেছিলাম। ঘরে তুলেছিলাম ২০০ মণ বীজ। এবার মোট ৩৫ একরের উপরে জমিতে চাষ করেছি। অনেক শ্রম দিতে হয়, কষ্ট করতে হয়। বীজের অনেক যত্ন করতে হয়।’

ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. হজরত আলী বলেন, ‘পেঁয়াজ ও পেঁয়াজ বীজের চাষে শাহিদা বেগম একটি নাম নয়; একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছেন। 

তার পেঁয়াজ ও বীজের কারণে সামনের দিনে দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি আর থাকবে না বলে মনে হচ্ছে।’ জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, ‘পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে অসামান্য সাফল্য অর্জনকারী নারী উদ্যোক্তা শাহিদা বেগম।

সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি এবং প্রবর্তিত কৃষি প্রণোদনার ওপর ভর করে এ ধরনের লাখ লাখ শাহিদার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে আজকের বাংলাদেশ। শাহিদা বেগমের পেঁয়াজ বীজ সারা দেশের পেঁয়াজ চাষে যে ভূমিকা রাখছে, তা একটি জেলার জন্য গর্বের।’