ঢাকা বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫

যমুনাসহ ৫ নদী থেকে প্রতি রাতে কোটি টাকার বালু লুট

আফরোজা লুনা, গাইবান্ধা
প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৫, ১১:২৪ পিএম
গাইবান্ধায় নদী থেকে প্রতিরাতে কোটি টাকার বালু লুট করা হয়। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

গাইবান্ধার অন্তত ২১টি পয়েন্টে বালুদস্যুরা তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদী থেকে রাতভর বালু উত্তোলন করছে।

বালুভর্তি প্রতি ট্রাক ও প্রতি নৌকার জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার ও মাস্তানদের তিন শ টাকা দিলেই খালাস। আর এই এক ট্রাক ভেজা বালু রাতেই খালাস করা হয় ১২ শ টাকায়।  

স্থানীয় প্রশাসন এসব দেখেও না দেখার ভান করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই বালুখেকো মাস্তানরা অল্প সময়েই কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন। বালু ব্যবসায়ীরা সবার কাছে চেনা মুখ হলেও তাদের ভয়ে কেউ কথা বলতে সাহস পান না।

কাপাসিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মনজু মিয়া বলেন, ‘গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল চষে বেড়ান ভয়ংকর অপরাধীরা। সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীর কছিম বাজার এলাকায়, চেয়ারম্যান মঞ্জু মিয়ার এলাকায়, তার ছায়ায় থেকে বালুদস্যুরা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে রাতে সরব হয়ে ওঠে।’ 

তিনি জানান, রাতে ট্রাক্টরের বিকট শব্দে নদীর তীর থেকে বালু নিয়ে ছোটে গন্তব্যে। দিনের বালুচরের দৃশ্য এক রকম। রাতের বালুচর দস্যুদের কবজায় চলে যায়। সবচেয়ে বেশি বালু উত্তোলন করা হচ্ছে সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীর বালুচর থেকে।

তিনি আরও জানান, সুন্দরগঞ্জে সিচা নামক বাজার এলাকা থেকে সোজা পূর্ব দিকে কিছু দুর গেলেই চোখে পড়বে বালুদস্যুদের পদচারণা। দিনের বেলা অন্য রকম হলেও সিচা থেকে তিস্তা নদীর কছিম বাজার, বাবুর বাজার, ফুলমিয়ার বাজার এলাকা সন্ধ্যার পর হয়ে ওঠে ভয়ংকর। ওই এলাকার একাধিক ডাকাতি, ছিনতাই মামলার আসামি রেজাউল নামের এক ব্যক্তি তিনটি পয়েন্টে বালু উত্তোলনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তার কথায় তিন পয়েন্টে বড় বড় নৌকায় বালু ওঠে তিস্তার চর থেকে।’

পোড়ার চরের সাবেক মেম্বার রেজা মিয়া বলেন, ‘নদীর ওপার থেকে নৌকায় বালু এনে রাখা হয় এপারের ওই তিন পয়েন্টে। তারপর লেনদেন মিটে গেলেই সারি সারি ট্রাক্টরে তুলে দেওয়া হয় বালু। ট্রাকে তুলে দিলে প্রতি ট্রাকের বালুর দাম দিতে হয় তিন থেকে ৫ শ টাকা আর নৌকা ভাড়া ৩ শ টাকা । তারপর ৮ শ টাকায় ট্রাকভতি বালু বিকট শব্দে পৌঁছে যায় গন্তব্যে। ৮ শ টাকার বালু গন্তব্যে পৌঁছে দিলে কাস্টমারকে দিতে হয় ২ হাজার থেকে ২২ শ টাকা।’

তিস্তার চরাঞ্চলের হাফিজার মিয়া বলেন, ‘চোর-ডাকাতরা রাতে বালুর ব্যবসা করে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো সাহস কারো নেই। এখানে পুলিশও আসে না, সরকারি কর্মকর্তারাও আসে না। যদিও আসেন তারা, দিনের বেলা এসে কোনো কিছুই দেখতে পান না। এই বালু ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে এমন কোনো অপরাধ নেই, তারা করেন না। খুন, ধর্ষণ, ভূমি দখল, মারপিট, অপহরণসহ সব অপকর্মে জড়িত তারা।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘তারা দিনের বেলা আত্মগোপন করে থাকে দুর্গম চরাঞ্চলের গোপন জায়গায়। নৌ ডাকাতি, ছিনতাই ও বালুচরের বাসিন্দাদের জমি দখল, নৌপথে ডাকাতির মতো অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। নদীতে পানি হলেই এরা আন্তঃজেলা নৌ ডাকাতিতে মেতে ওঠে। এখন শুষ্ক মৌসুমে বালুচর দখল, দস্যুতা ও তিস্তা, যমুনায় বালুদস্যুরা রাতের রাজা হিসেবে পরিচিত পেয়েছে চরাঞ্চলে।’

ফুলছড়ি উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বালু পয়েন্টের নাম কঞ্চিপাড়া, সৈয়দপুর ও বালাসীঘাট। এই তিন পয়েন্টে থেকে দিনের বেলা কোনো বালু উঠানো হয় না । কিন্তু রাতের বালু তোলার দৃশ্য দেখলে মনে হবে নদী থেকে প্রতি রাতে কোটি টাকার বালু হরিলুট হচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই সৈয়দপুরঘাট, কামারজানি ও বালাসীঘাটে নদীর বুকে নেমে যায় শতাধিক ট্রাক। তারপর শুরু হয় প্রতিযোগিতা, কে আগে ট্রাক ভরিয়ে রওনা হবেন গন্তব্যে।’

বালাসীঘাটের বাসিন্দা নুরন্নবী সরকার বলেন, ‘নদীর বুক থেকে ভেজা বালু ট্রাকে ভরে বিকট শব্দে গাইবান্ধা শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে নেয় কিংবা পাহাড় সমান করে ঢিবি করে রাখে বালু। বিনা পয়সায় বালু এনে প্রতি ট্রাক বালু বিক্রি করা হয় ২৪ শ টাকায়। আর রাস্তার পাশে বালু ঢিবি দিয়ে খুচরা বিক্রি হচ্ছে সিমেন্টের ব্যাগের ১০ বস্তা বালু ৫ শ টাকা। তাও আবার অবস্থান ভেদে বেশিও নেওয়া হয়। একই পদ্ধতি অবলম্বন করে বালুদস্যুরা রাতের বেলায় যমুনা নদী থেকে বালু লুট করছে সাঘাটার কাঠকালি মন্দির এলাকায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘হলদিয়ার চর, সাঘাটা বাজার, ঘাঘট নদীর শহর এলাকার কুঠিপাড়া, গোদারহাট, করতোয়া নদীর কাটাখালী সেতু এলাকার পাশে থেকেও বালু ব্যবসায়ীরা রাতেই বালু চুরি করে ট্রাক ভর্তি করে বিক্রি করে থাকেন। গাইবান্ধার কামারজানিতে যমুনা নদী থেকে বালু উত্তোলন নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন কয়েকবার মামলা করেছেন বালু খেকোদের বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রতিরোধ করা যায়নি।’