শতবর্ষী মাকে খুশি করতে স্ত্রী শাহিদা বেগমকে (৬৫) হত্যা করে মরদেহ সেপটিক টাংকিতে ফেলে দেয় স্বামী আবদুল মোমিন।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ঘোলপাশা ইউনিয়নের ধনুসাড়া গ্রামে শাহিদা বেগমকে হত্যা করা হয়। ওই বৃদ্ধার স্বামী একটি মসজিদের ইমাম।
ঘটনার পর স্বামী আবদুল মমিন প্রচার করেন- স্ত্রীকে ফজরের নামাজ পড়তে বলে মসজিদে চলে যান তিনি। ফিরে এসে দেখেন স্ত্রীর খোঁজ নেই। পরে টানাহেঁচড়ার চিহ্ন দেখে সেপটিক ট্যাংকের স্লাব খুলে দেখেন স্ত্রীর মরদেহ।
এ ঘটনায় ওই বৃদ্ধার ছেলে মো. মাছুম বিল্লাহ থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১ নম্বর সাক্ষী করা হয় বৃদ্ধার স্বামী ৬৮ বছর বয়সি আবদুল মমিনকে।
দীর্ঘ তদন্ত আর জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ অবশেষে নিশ্চিত হয় ওই বৃদ্ধার স্বামীই বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার পর স্ত্রীর মরদেহ বিবস্ত্র অবস্থায় ফেলেন সেপটিক ট্যাংকে।
বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত তুলে ধরেন চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি মোহাম্মদ হিলাল উদ্দীন আহমেদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ক্লু-লেস এই হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা চৌদ্দগ্রাম থানার উপপরিদর্শক হেশাম উদ্দিন।
পুলিশ জানায়, বুধবার বিকেলে কুমিল্লার আদালতে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আবদুল মমিন।
সেখানে মমিন দাবি করেছেন- পারিবারিক কলহ এবং তার ১৩০ বছর বয়সি মা আতর বানুর সেবাযত্ন করতে অনীহা প্রকাশ করায় কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে স্ত্রীকে হত্যা করেছেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি মোহাম্মদ হিলাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ঘটনার পর বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের সন্দেহ হয় আবদুল মমিনের ওপর। এরপর আমরা তাকে নজরদারিতে রাখি। একপর্যায়ে গত ২৭ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে আদালতে প্রেরণ করা হয়। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হলে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ২১ এপ্রিল তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে চৌদ্দগ্রাম থানায় আনা হয়।
এরপর দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মমিন স্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। সর্বশেষ বুধবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ঘটনার বিস্তারিত প্রকাশ করেন তিনি।
জবানবন্দিতে আবদুল মমিন দাবি করেন, তার মায়ের বয়স ১৩০ বছরের কাছাকাছি। তার মা চলাফেরা করতে পারতেন না, তবে সুস্থ আছেন। মায়ের সেবাযত্ন নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় সময় তাদের ঝগড়া হতো। মমিন ও তার ভাই পালাক্রমে এক মাস করে তাদের মায়ের দায়িত্ব নিয়ে সেবাযত্ন করতেন।
মমিনের ছেলে তাদের পুরাতন বাড়িতে মা এবং পরিবার নিয়ে থাকতেন। মমিন থাকতেন ঘোলপাশা মসজিদ সংলগ্ন তাদের নতুন বাড়িতে। তার মা যখন তাদের পুরাতন বাড়িতে অবস্থান করছিলেন তখন মমিন সেখানে মায়ের খোঁজখবর নিতে যান। তখন তার মা তার কাছে নালিশ করে যে, তার স্ত্রী মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন। তখন মমিন মনে মনে রাগান্বিত হন এবং মমিন তার নতুন বাড়িতে ফিরে আসে।
ওইদিন গভীর রাতে নতুন বাড়িতে শারীরিক সম্পর্ক শেষে মমিন তার স্ত্রী শাহিদা বেগমকে তার মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণের বিষয়টি জিজ্ঞেস করেন। এতে শহিদা রাগান্বিত হয়ে মমিনকে বিভিন্ন গালমন্দ শুরু করেন। মমিন এতে বিরক্ত হয়ে তার পাশে থাকা বালিশ দিয়ে স্ত্রীর নাক, মুখ চেপে ধরে রাখেন। কিছুক্ষণ পর দেখেন যে, স্ত্রী আর নড়াচড়া করছে না।
জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, এ ঘটনার পর অনেক চিন্তাভাবনা করে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে মরদেহ কাঁধে করে বাড়ির উত্তর পাশে টয়লেটের সেপটিক ট্যাংকে ফেলেন এবং ঢাকনাটি আবার লাগিয়ে দেন। মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় তার পেটিকোটটি তার শরীর থেকে পড়ে গিয়েছিল। মমিন মরদেহ সেপটিক ট্যাংকে ফেলার পর বাড়ির নলকূপে গোসল করে পেটিকোটটি বালতির মধ্যে রেখে ৫টার দিকে মসজিদে চলে যান।
এরপর মসজিদ থেকে এসে তার ছেলেকে ফোন দিয়ে বলেন, তোমার মাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে তার ছেলেসহ আশপাশের লোকজন নতুন বাড়িতে এসে খুঁজতে থাকে এবং একপর্যায়ে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মরদেহ সেপটিক ট্যাংকে দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেন।
সংবাদ সম্মেলনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হেশাম উদ্দিন বলেন, আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি একাই পুরো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে এই মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে দাখিল করা সম্ভব হবে।