ঢাকা রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

নদী ভাঙতে ভাঙতে আমরা নিঃস্ব, ব্রহ্মপুত্রে বিলীন ক্লিনিক ও স্কুল

মাসুদ রানা, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৪, ১০:৪৭ পিএম

নদী ভাঙতে ভাঙতে আমরা নিঃস্ব, ব্রহ্মপুত্রে বিলীন ক্লিনিক ও স্কুল

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

উজান থেকে নেমে আসা পানির পরিমাণ কমে গেছে। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিও নেই। এতে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমলেও চলছে ভয়াবহ ভাঙন। নদীভাঙনে ইতিমধ্যে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ৫, ৬, ৮ ও  ৯নং ওয়ার্ডের কয়েকটি চর ও দ্বীপচরে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। অব্যাহত ভাঙনে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে যাত্রাপুর ইউনিয়নের আয়তন। নিশ্চহ্নের পথে ইউনিয়নের বরুয়া, রলাকাটা সহ ভগবতীপুর এলাকা৷ দেড়মাস ধরা চলা অব্যাহত আগ্রাসী এ ভাঙনে ৭০টি পরিবারের বসতভিটা ও অসংখ্য ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এতে গৃহহারা হয়ে পড়েছে অন্তত পাঁচশতাধিক মানুষ।  ভাঙনে বিলীন হয়েছে দ্বীপচর ভগবতীপুরের কমিউনিটি ক্লিনিক, ঝুনকার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভগবতীপুর উত্তর-পূর্ব আবাসন প্রকল্প। কমিউনিটি ক্লিনিক নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় চিকিৎসা সেবা নিতে বিড়ম্বনায় পরতে হচ্ছে ওই এলাকার মানুষের। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে পশ্চিম ভগবতীপুর আবাসন প্রকল্প, ভগবতীপুর মসজিদ সহ ইউনিয়নের কয়েক শত পরিবারের বসতভিটা। ভাঙন কবলিত এসব এলাকার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

সোমবার (২৪ জুন) সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দ্বীপ চর ভগবতীপুরের ভাঙনের শিকার পরিবার গুলো তাদের জিনিসপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। অনেকেই ঘরের চাল ও বেড়া খুলে রেখেছেন। খোলা আকাশের নিচে থাকা এসব পরিবার কোথায় যাবেন জানেন তাঁরা। ভাঙনের শিকার এসব পরিবারের অনেকের ঘরের ধাপড়ীর অবশিষ্ট অংশ পড়ে রয়েছে। রান্না ঘর গুলোর ধাপড়ীতে পরে আছে চুলা। কিন্তু ভাঙন আতঙ্কে তাঁরা রান্না করে খেতে পারছেন না। অনেকেই জিনিসপত্র নৌকা যোগে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন৷ আবার অনেকেই বসতভিটার শেষটুকু নদীগর্ভে বিলীনের চিত্র দেখার জন্য বিষন্ন মনে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকেই অন্যের জমিতে গিয়ে নতুন করে ঘর উত্তোলন করছেন। নতুন করে বসতি গড়া এসব পরিবারও রয়েছেন অনিশ্চয়তায়। ভাঙনের বিভিষীকায় থাকা এসব পরিবার উপার্জন করতে না পারায় অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন।

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের শিকার ভগবতীপুরের দিনমজুর ছালাম মিয়া (৩০)। বসতবাড়ির কিছু জিনিস পত্র অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন তিনি ও তাঁর পরিবার।  অবশিষ্ট জিনিস পত্রও সরিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। পুরো পরিবারটির চোখে মুখে যেন ভাঙনের বিষাদ। নরম স্বরে জানতে চাইলে 'রুপালী বাংলাদেশকে 'ছালাম বলেন, 'আমার জন্মের পর থেকে এভাবেই নদী ভাঙন দেখে আসছি। ভাঙনের শিকার হয়ে ১০-১৫ বার বসতবাড়ী অন্য সরিয়ে নিয়েছি। নদী ভাঙতে ভাঙতে আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি। এখন আমরা কোথায় যাবো জানিনা!'

একই পরিস্থিতি ওই এলাকার সত্তুর উর্ধ বৃদ্ধ আমানত আলীরও। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পরা আমানত আলী 'রুপালী বাংলাদেশ'কে বলেন, 'আনুমানিক ৩০ বার বসতবাড়ী নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। ৩০/৩৫ বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলিন হয়েছে। এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেটিও শেষ। পুনঃরায় বসতবাড়ী করার মতো উপায় আমাদের নেই।'

৫ ছেলে ও ছেলেদের স্ত্রী-সন্তান মিলে মোট ১৪ জন সদস্যের পরিবার বর্গাচাষী আব্দুল খালেকের (৬৫)। ৫০ বছর আগে যাত্রাপুরের ঝুনকার চরে থাকা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। পরে বিভিন্ন জায়গায় নদীভাঙনের শিকার হয়ে ভগবতীপুরের পশ্চিমে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেও ভাঙনের শিকার হয়ে অন্যের জমিতে এসে ঘর উত্তোলন করছেন। কিন্তু সেখানেও চলছে নদী ভাঙন। এরপর পরিবারকে নিয়ে কোথায় যাবেন জানেন না তিনি!

বর্গাচাষী আব্দুল খালেক 'রুপালী বাংলাদেশ'কে বলেন, '৫০ বছর আগে বাপ-দাদার সম্পত্তি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এরপর বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে নদী ভাঙনের শিকার হয়েছিলাম। সর্বশেষ ভগবতীপুরে পশ্চিমে আশ্রয় নিয়ে ভাঙনের শিকার হয়ে দক্ষিণে এসে অন্যের জায়গায় ঘর তুলতেছি। সেটিও ভাঙনের মুখে। না জানি কখন সেটিও ভেঙে যায়।'

যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর 'রুপালী বাংলাদেশ'কে বলেন, আমার ইউনিয়নের ৫, ৬, ৮ ও  ৯নং ওয়ার্ডের কয়েকটি চর ও দ্বীপচরে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ভাঙনের শিকার হয়ে ৬৫-৭০টি পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক দেয়া ১০ কেজি করে চাউল ও শুকনো খাবার ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে পাউবো কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান 'রুপালী বাংলাদেশ'কে বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন রোধে জেলার দইখাওয়ার চর, সোনাপুর, জাহাজের আলগা সহ কয়েকটি স্থানে জিও ফেলা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়াও ব্রহ্মপুত্রের বাম তীর রক্ষায় একটি বড় প্রকল্পের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটির অনুমোদন পেলে কার্যক্রম শুরু করা হবে।'

Link copied!