বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা এস এম জাকির হোসেনের স্ত্রীর দখলে রয়েছে শতকোটি টাকা মূল্যের সরকারি জমি। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করাসহ সাবেক জেলা প্রশাসক ও গুটিকয়েক কর্মচারীকে ঘুষ দিয়ে বরিশাল বেলস পার্কসংলগ্ন মহামূল্যবান ভূমিটি কবজা করেছেন। এমনকি ভূমি আইন লঙ্ঘন করে সেখানে বহুতল বভন নির্মাণ শেষে ইউরো ক্যাফে নামক কথিত এই রেস্তোরাঁ থেকে কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগের প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতেও রেস্তোরাঁটিতে একাধিকবার বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে কথিত রেস্তোরাঁ অর্থাৎ নৌকার প্রচারকেন্দ্রটিতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছেন হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. অজিয়র রহমানসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বেলস পার্কসংলগ্ন অফিসার্স ক্লাবের মূল্যবান ভূমিটি বিতর্কিত আওয়ামী লীগ নেতা এস এম জাকির হোসেন তার স্ত্রী ফাতেমা ফারুকীর নামে বরাদ্দ নিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বহুতল ভবন বা রেস্তোরাঁ করায় পার্শ্ববর্তী সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করলে সাবেক মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে দিয়ে চাপ প্রয়োগ করেন। ফলে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতা জাকিরের স্ত্রীর নামে সরকারি ভূমিটি ১০ বছরের জন্য ইজারা দিতে বাধ্য হন তৎকালীন জেলা প্রশাসক।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকারি ইজারাপ্রাপ্ত ভূমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের সুযোগ আইনে নেই। কিন্তু তার পরেও ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করাসহ তৎকালীন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তিনি তিনতলা ভবন করেছেন। ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও জাকির হোসেন মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ লাগোয়া ভবনটি নির্মাণ করেন। পরবর্তী সময়ে ওই ভবন থেকে আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলটির পক্ষে বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা, এমনকি নির্বাচনী কার্যক্রমও চালানো হয়।
আওয়ামী লীগের শাসনামলের সময় সারা দেশে অবৈধভাবে নির্মিত ভবনগুলোর অধিকাংশ ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভেঙে ফেললেও বরিশালের আ.লীগ নেতা জাকিরের ভবনটি এখনো সুরক্ষিত আছে এবং সেখানে তিনি এখনো ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা এস এম জাকির সরকারি ভূমিতে অবৈধভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে ইমারত নির্মাণ আইনকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। কোনো প্রকার নির্মাণশৈলী ছাড়াই তিনি বেলস পার্কসংলগ্ন ভূমিতে ভবনটি করেছেন। পরে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে অবৈধ ভবনের প্ল্যান করতে সিটি করপোরেশনে দৌড়ঝাঁপও শুরু হয়।
এই তথ্য নিশ্চিত করে বরিশাল সিটি করপোরেশনের সূত্র জানিয়েছে, কোনো অনুমোদন না নিয়েই ইউরো ক্যাফে নামক রেস্তোরাঁটি নির্মাণ করা হয়েছে, যা পুরোপুরি অবৈধ। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে ভবনটির নির্মাণশৈলী নিতে কয়েকবার লোকজন এসেছিল। কিন্তু কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা এস এম জাকির হোসেনের স্ত্রীর নামে শুধু ইউরো ক্যাফের ভূমিই ইজারা দেওয়া হয়নি, অফিসার্স মেসের দুটি কক্ষও বরাদ্দ দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। সেখানে জাকিরের ইউরো কনভেনশন হল নামের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও করেছেন। জেলা প্রশাসনকে নামমাত্র রাজস্ব দিয়ে উভয় প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক বছর ধরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচার-প্রচারণা।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বরিশাল সদর উপজেলা থেকে এস এম জাকির হোসেন চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই নির্বাচন পরিচালনা করা হয় সরকারি ভূমিতে থাকা ওই দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে। এমনকি চলতি বছরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের একতরফা সংসদ নির্বাচনেও দুটি ভবনকে প্রচারকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতেও ভবনটিতে কয়েক দফা বৈঠক করেন এস এম জাকিরসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
ক্ষমতার আমলে শুধু বরিশালে নয়, এস এম জাকির সন্ত্রাসের ডালপালা রাজধানী ঢাকায়ও বিস্তৃত করেছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পূর্বাপর তিনি রাজধানীতেও ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে মূর্তিমান সন্ত্রাসীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। নেত্রীকে দেশছাড়া করার ক্ষোভে জাকির ওই দিন রাতে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে হামলা চালিয়েছেন। এবং এতে আল-আমিন নামের এক আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন, যে ঘটনায় নিহত আল-আমিনের চাচা বাদী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং বরিশালের আওয়ামী সন্ত্রাসী জাকিরসহ পাঁচশতাধিক লোকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
জানা গেছে, বাড্ডার ওই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জাকিরের সাথে তার বরিশালের আরও অন্তত ১০-১২ সহযোগী অংশ নিয়েছিল। অবশ্য তাদের কারো নাম মামলাটিতে না থাকলেও পুলিশ জানিয়েছে, তদন্তে সবার নাম উঠে আসবে এবং তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী সন্ত্রাসী জাকির জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রাক্কালে বরিশাল এবং ঢাকা উভয় স্থানে অবস্থান করছিলেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসায় তিনি অবস্থান নিয়ে থাকলেও একেক সময় একেক জায়গায় গুণ্ডাবাহিনী নিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা চালিয়েছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে তিনি কদিন আত্মরক্ষার্থে অন্তর্ধানে থাকলেও পরবর্তী সময়ে কৌশলে বরিশালে এসে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের সাথে সখ্য গড়ে তোলার মরিয়া চেষ্টা করেন। কিন্তু অতীত অপকর্মের কারণে তিনি তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি। এর মধ্যেই প্রকাশ্যে আসল বাড্ডায় তার নেতৃত্বে ৫ আগস্ট আন্দোলনকারী খুনের তথ্য-উপাত্ত, যা বরিশালের রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সুশীলমহলকে রীতিমতো হতবাক-বাকরুদ্ধ করেছে।
আন্দোলনকারীকে খুন করাসহ আওয়ামী লীগ নেতা এস এম জাকিরের অতীত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ করেছেন বরিশালের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাদের ভাষায়, এস এম জাকির ক্ষমতার থাকার সময় দখল সন্ত্রাস, সাংবাদিক নিপীড়নসহ সরকারি শতকোটি টাকার ভূমি পর্যন্ত দখল করেছেন। তার হাত থেকে রেহাই পাননি নারী সাংবাদিকও।
তিনি কোটি কোটি টাকা কামানোর পাশাপাশি খিস্ট্রান সম্প্রদায়কে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাকে ওই সম্প্রদায়টি সন্ত্রাস ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী হিসেবেও উল্লেখ করে সে সময়ে শাস্তি দাবি করেছিল। কিন্তু স্থানীয় মন্ত্রী, মেয়র, এমনকি সাবেক আইসিটি মন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের আস্থাভাজন হওয়ায় তার লাগাম টানা সম্ভবপর হয়নি।
ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে থানা পুলিশ কিংবা আদালতে গিয়েও ন্যায়বিচার পাননি, বরং আরও হয়রানির শিকার হতে হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নেতা এস এম জাকির স্কুলের পাশে সরকারি জমিতে এমনভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন, সেখান থেকে স্কুলের নারী শিক্ষার্থীদের মুভমেন্টের ছবি বা ভিডিও ধারণ করা খুব সহজ। এতে শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীরাও চাইছেন স্বৈরাচার লীগের দোসর জাকিরের স্ত্রীর নামে নির্মিত ভবনটি দ্রুত অপসারণ বা ভেঙে ফেলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্ল্যান শাখার একজন কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, সরকারি ভূমিতে নির্মিত আওয়ামী লীগ নেতা জাকিরের স্ত্রীর নামের ভবনটির কোনো আইন মেনে করা হয়নি। তা ছাড়া ক্ষমতার দাপটে তিনি ভূমি আইনও লঙ্ঘন করেছেন, যা তদন্তে উঠে এসেছে। সব কিছু বিবেচনা করে ভবনটির প্ল্যান না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এদিকে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, জাকিরের স্ত্রীর নামে নকশাবহির্ভূত ভবনটি উচ্ছেদে বরিশাল আদালতে একটি মামলার প্রস্তুতি নিয়েছেন সমাজকর্মীরা। সম্ভবত এই মামলাটি আগামী সপ্তাহের মধ্যে হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এস এম জাকির গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে গিয়েছেন এবং খুনের মামলা থেকে রেহাই পেতে বাদীকে ম্যানেজ করতে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসায় বা নিরাপদ কোথাও অবস্থান নিয়ে আছেন।
মোহাম্মদপুর বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন চলাকালীন জাকিরকে একাধিকবার সেখানে যাতায়াত করেতে দেখা যায়। কিন্তু তিনি যে বরিশালে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে রাজধানীতে কিলিং মিশনে অংশ নেবেন, এমনটা কারো ধারণাও ছিল না। এই খুনিকে দেখা মাত্রই গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দিতে মোহাম্মপুরের বাসিন্দারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
এদিকে সরকারি ভূমিতে অবৈধ ভবন নির্মাণ করায় বরিশাল জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যেও ক্ষোভ রয়েছে। তারা ভবনটি জাকিরের কবজা থেকে উদ্ধার করার কথা জানিয়েছেন। তবে এই বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলতে আপত্তি জানিয়েছেন বরিশালের নতুন জেলা প্রশাসক ও অফিসার্স ক্লাবের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। তিনি জানান, ভূমিটি পূর্বের জেলা প্রশাসক বরাদ্দ দিয়ে গেছেন, ফলে না জেনে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছেন না।
আপনার মতামত লিখুন :