কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হিসনা নদী দখলের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় একটি মহল নদীর জায়গা দখল করে নির্মাণ করেছে স্থায়ী বসত। নদীতে বাঁধ দিয়ে লিজের নামে ব্যক্তি মালিকানায় চলছে মাছ চাষ আর শুকনো মৌসুমে চাষাবাদ। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, হিসনা নদী প্রতিনিয়তই দখল হচ্ছে কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বিকার। তাদের দাবি সরকার আসে, সরকার যায়, দখলদারিত্বের কিছু অংশ হাতবদল হয় কিন্তু হিসনার ভাগ্য অপরিবর্তিত থেকে যায়।
জানা গেছে, এক সময়ের খরস্রোতা হিসনা নদী ও এর শাখাসমূহ উপজেলার পৌরসভাসহ ধরমপুর, জুনিয়াদহ, চাঁদগ্রাম, মোকারমপুর ইউনিয়নের অন্তত ২০ গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। নদীটি দৌলতপুরের মুসলিমনগরে পদ্মা নদীর শাখা হিসেবে উৎপত্তি হয়ে মিরপুরের চিথুলিয়া হতে সাগরখালী নাম ধারণ করে চাপাইগাছি বিলে পতিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৫২ কিলোমিটার ও প্রস্থ ৪২ মিটার। ভেড়ামারা অংশে নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫-২০ কিমি এবং এর শাখা নদীসহ আরও ২০ কিমি।
উপজেলার হিসনা ব্রিজ পয়েন্ট থেকে কাঠেরপুলের শেষ সীমানা পর্যন্ত ১৩৬০, ১৩৬২, ১৩৫৩, ১৩৪০-৪১, ১৩২৪-২৫, ১৩১৮, ১৩১৬ দাগগুলো নদীর ভেতরে অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ৫৩ ও ৬২ দাগ ব্যক্তি মালিকানায় অধিভুক্ত আছে। ১৩৫৩ দাগের রেকর্ড সালেহা খানমের নামে। সম্প্রতি তাকে ভূমি অফিসে ডেকে নোটিশ করা হয়েছে। ১৩৬২ দাগের ওপর নির্মিত বাড়ি নিয়ে ইউএনও অফিসে একাধিকবার সালিশ হয়েছে কিন্তু সুরাহা হয়নি। বাকি দাগগুলো নদীর খাসজমি, যা অন্যরা চাষাবাদ ও ভোগ দখল করছে।
আরো জানা গেছে, ১৯৫৬-৫৭ সালে অনেকেই ‘স্থায়ী বন্দোবস্ত’ (পিআর) এর মাধ্যমে নদীর জমি সরকারের থেকে লিজ নিয়ে ১৯৭৬ সালে আর এস (রিভিশনাল সার্ভে) এর মাধ্যমে তা নিজ নামে রেকর্ড করে নেয়।
হিসনা ব্রিজের দক্ষিণ পাশে নদীর কিছু অংশে প্রস্থ ৪০ মিটার আছে। বাদবাকি অধিকাংশ জায়গায় তা কমে ১৫-২০ মিটারের মতো আছে। কৌশলে ব্রিজের নিচে বাঁধ দিয়ে পানি চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। দুই পাশে চলছে নদী দখল । নদীর দুপাশ দখল হয়ে প্রস্থ কমে সরু হয়ে নদী মরাখালে পরিণত হয়েছে। অথচ এই অংশ দিয়েই চলত এক সময় বড় বড় নৌকা। অভিযোগ আছে, এখানে নদীর জায়গা দখল করে নির্মিত হয়েছে বাড়ি। তবে প্রতিটি বাড়িওয়ালা নিজেদের কাগজ আছে বলে সাফাই গেয়েছেন। এই অংশে নদীর ওপর নির্মিত কাঠেরপুল নদীর প্রস্থের অর্ধেকেরও কম। ভূমি অফিস থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ১ ও ১৫২ দুটি পাশাপাশি দাগের নদীর অস্তিত্ব ম্যাপে থাকলেও নদীর জায়গা বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকদের নামে রেকর্ড হয়ে আছে। এখানে নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজের ১৫১নং দাগটি আবার সরকারের নামে। ব্রিজটি নদীর প্রস্থের ৮ ভাগের ১ ভাগ (যা আইনসিদ্ধ নয়)। ১ নং ও ১৫২নং দাগের ঠিক পাশের ৭২১নং দাগটি আবার নদীর নামে।
সম্প্রতি নদীর জায়গা দখল করে বালি ফেলার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। ভূমি অফিস থেকে বারবার মাটি সরানোর নোটিশ করেও সুরাহা মেলেনি।
ভেড়ামারার উত্তর রেলগেট এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শুকনো মৌসুমে নদীতে ধান চাষ হয়। দখলরা নদীর অস্তিত্ব অস্বীকার করে। দখলকৃত জমি একাধিকবার হাত বদলও হয়েছে। নদীর এই অংশের ওপর নির্মিত ফারাকপুর ব্রিজের নিচে ইট দিয়ে স্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়েছে। স্রোত ও নাব্যতা হারিয়ে মরাখালে পরিণত হয়েছে নদীর এই অংশটি।
স্থানীয় বাসিন্দা রমজান আলী বলেন, এভাবে চললে আগামী ২০ বছরেই হিসনা নদীর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমরাও বিষয়টি লক্ষ করেছি। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক নদীর ওপর নির্মিত প্রত্যেকটি ব্রিজকে অবশ্যই নদীর প্রস্থের সমান হতে হবে। নদীর জায়গা দখল নিয়ে তিনি বলেন, মূলত বন্দোবস্তের মাধ্যমে অনেকেই সরকারের থেকে লিজ নেওয়া নদীর জায়গা পরবর্তীতে নিজের নামে রেকর্ড করে রেখেছে। সরকারিভাবে নদী খননের উদ্যোগ নিলেই কেবল অবৈধ স্থাপনা দূর করতে পারব।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) আনোয়ার হোসাইন বলেন, ইতোমধ্যে সংস্কারের লক্ষ্যে হিসনা নদীর নাম আমরা পাঠিয়েছি। নদী সংস্কারের ব্যাপারে নির্দেশনা পেলে নদী দখল মুক্ত করার জন্য যা প্রয়োজন সেটাই আমরা করব।
ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা জলমহালের সভাপতি মো. মিজানুর রহমান বলেন, যারা বাঁধ দিয়ে নদীর স্রোতপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে, নদীর জমি দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইজারা দিয়ে উন্মুক্ত নদীতে ব্যক্তি বিশেষকে মাছ চাষ করতে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আপনার মতামত লিখুন :