বাহারি সুতা আর নিপুণ কারুকার্যের তৈরি টাঙ্গাইলের শাল চাদরের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়ে চললেও কমে যাচ্ছে শাল চাদর তৈরির কারখানা। তাঁত শিল্পে বাংলাদেশের অন্যতম একটি জেলা টাঙ্গাইল। বংশাল, মনিপুরী, নয়নতারাসহ নানা ডিজাইনের চাদর তৈরি করছে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার বাথুলি সাদী এলাকার কারিগররা। নাগরপুর ও দেলদুয়ার উপজেলার কিছু এলাকায়ও শাল চাদর তৈরির কারখানা রয়েছে। তাঁতের শাড়ির পরেই বাহারি সুতার নিপুণ কারুকার্যের ফ্যাশনেবল এই চাদর নারী-পুরুষ উভয়ের কাছেই দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
শাল চাদর তৈরির কারখানার মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের তুলনায় এবছর বিক্রি বেশি হয়েছে। তবে সুতার দাম বেড়েই চলছে, কিন্তু বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে না চাদর। ফলে আশানুরূপ লাভ না পাওয়ায় কারখানা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পরছে।
তাঁত মালিক জাহিদুল ইসলাম জানায়, সুতার দাম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে আগে একটা চাদরে যে পরিমাণ লাভ হতো এখন আর সেই পরিমাণ লাভ হয় না। কোন কোন তাঁতি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অথবা সুদ হারে টাকা নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। ব্যাংকের লাভ এবং সুদের টাকা পরিশোধ করার পর তাঁতিদের খুব বেশি লাভ থাকে না। কোনরকমে শুধু পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে আছে। গত বছর সময়মত শীত না পরার কারণে ব্যবসা মন্দা হওয়ায় অনেক তাঁত মালিক ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। এবছর কিছুটা আগেই শীত পরার কারণে গত বছরের তুলনায় চাদর বিক্রি ভালো হয়েছে বলে জানান তিনি।
আরেকজন তাঁতি নুরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকা যেমন কক্সবাজার, শ্রীমঙ্গল, সিলেট, রাঙ্গামাটিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় টাঙ্গাইলের তৈরি শাল চাদরের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদেরকে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে এবং টাঙ্গাইলের শাড়ির মতো টাঙ্গাইলের তৈরি শাল চাদর দেশের বাহিরে রপ্তানি করার ব্যবস্থা করলে টাঙ্গাইলের চাদর তৈরির কারখানা ভালোভাবে টিকে থাকতে পারবে।
একজন কারিগর প্রতিদিন, কিছু ডিজাইনের চাদর ৮-১০টা এবং কিছু ডিজাইনের চাদর ২০ টার মতো তৈরী করতে পারে পাওয়ারলোম মেশিনে। ডিজাইনের ভিন্নতায় প্রতি চাদরে মজুরি পায় ২৭ থেকে ৩৫ টাকা। আগে সারাবছরই কমবেশি কাজ থাকতো কারিগরদের, কিন্তু বর্তমানে বছরের ছয়মাস কাজ থাকে না, ফলে অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় কারিগরদের। অটোমেটিক মেশিন চালু হওয়ায় চাদর তৈরিতে কারিগরও কম লাগছে। অল্প মজুরি ও সারাবছর কাজ না থাকায় এবং অটোমেশিন চালু হওয়ায় চাদর তৈরির কারিগর দিন দিন কমে যাচ্ছে।
কারিগর ফকর মিয়া জানান, দীর্ঘদিন যাবৎ এই পেশায় কাজ করেন তিনি। সকাল ছয়টা থেকে রাত বারোটা অবধি কাজ করেন। সবকিছুর দাম বাড়লেও চাদর তৈরির মজুরি বাড়েনি। স্বল্প মজুরিতে কাজ করে সংসার চালানো খুবই কষ্টকর হয়ে পরেছে বলে জানান।
আরেকজন কারিগর ময়নাল হোসেন জানান, আগে সারা বছরই কাজ থাকতো, ব্যবসা মন্দা হওয়ার কারণে এখন বছরের ৬ মাস কাজ করা যায়, বাকি ৬ মাস চাদর তৈরির কারিগরদের অন্যান্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। একারনে এই পেশা থেকে কারিগর কমে যাচ্ছে।
কারিগর উদুদ মিয়া বলেন,অটোমেশিনে চাদর তৈরি হওয়ায় হাতের কাজের কারিগরের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে, যে কারণে দিন দিন চাদর তৈরির কারিগররা কর্মহীন হয়ে পরছে।
তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, চাদর তৈরির সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে জেলার প্রায় পাঁচ হাজার কারিগর। টাঙ্গাইলে তৈরি শাল চাদর করটিয়া হাট এবং অন্যান্য হাটে বিক্রির মাধ্যমে সারা দেশেই যাচ্ছে। তাঁত বোর্ডের পক্ষ থেকে বিনা জামানতে প্রান্তিক তাঁতিদের ৫℅ সুদে ত্রিশ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত এবং পাওয়ারলোম মেশিনের তাঁতিদের পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সহযোগিতা দেওয়া হয়। এই ঋণ তারা তিন বছরে পরিশোধ করার সুযোগ পায়। তাঁত বোর্ডে তাঁত শিল্পের শিল্পের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
টাঙ্গাইলের তৈরি শাল চাদর অন্যান্য পোশাক শিল্পের তৈরি পোশাকের মতো দেশের বাহিরে রপ্তানি করার ব্যবস্থা করা হলে কারখানার মালিকের কারখানা টিকিয়ে রাখতে সুবিধা হবে এবং সঠিক লাভ পেলে কারিগরদের মজুরি বাড়ানোও সম্ভব হবে। দেশের অর্থনৈতিক আয় যেমন বাড়বে, তেমনি কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে দাবী চাদর তৈরির সাথে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের।
আপনার মতামত লিখুন :