চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নানা অনিয়মের কারণে সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বাঁশখালীর লাখো মানুষ। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রান্তিক জনপদে অবস্থিত এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে আট জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা দেয়ার দায়িত্বে রয়েছেন।
শুক্রবার এবং সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত তারা প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত মানুষকে সেবা দেয়ার কথা থাকলেও এই বিধানের তোয়াক্কা করছেন চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিনের পর দিন এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিচালিত হচ্ছে অলিখিত নিজস্ব নিয়মে। আটজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা দেয়ার নিয়ম থাকলেও কেউ শনিবার-সোমবার, কেউ রবিবার-মঙ্গলবার-বৃহস্পতিবার, আবার কেউবা শনিবার-মঙ্গলবার-বৃহস্পতিবার স্বল্প সময় সেবা দেন।
উল্লেখিত দিনে তারা আবার বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতালে চেম্বার শিডিউল দিয়ে রাখেন। প্রাইভেট চেম্বারের সাথে মিল রেখেই মূলত তারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত সেবা দেয়ার কথা থাকলেও সকাল দশটার আগে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হাসপাতালে আসেন না। আবার বেলা একটার পরও কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে হাসপাতালের নির্ধারিত কক্ষে পাওয়া যায় না। এই তিন ঘন্টা সেবা দেয়ার মাঝখানে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কক্ষে চা বিরতির অলিখিত নিয়ম। এরমধ্যেই আবার রয়েছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের জন্য বিশেষ সময়।
এভাবে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করে প্রতিনিয়ত অবনতির দিকে যাচ্ছে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবা কার্যক্রম।
বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) বেলা একটা পনেরো মিনিটের সময় সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সবকটি কক্ষই তালাবদ্ধ। সার্জারী বিশেষজ্ঞের কক্ষ খোলা থাকলেও চিকিৎসক নেই। পাশের রুমে আবাসিক মেডিকেল অফিসার থাকলেও বেলা দেড়টার পর তিনিও বেরিয়ে যান। আবাসিক মেডিকেল অফিসার সার্বক্ষণিক বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকার কথা থাকলেও চন্দনাইশ উপজেলায় গিয়ে তিনি ব্যক্তিগত চেম্বার করেন নিয়মিত। এসময় এই প্রতিবেদকের উপস্থিতি টের পেয়ে টিকেট কাউন্টারের দায়িত্বরত ব্যক্তি পুনরায় কাউন্টার খুলে বসতেও দেখা যায়। যদিওবা টিকেট নিয়েও কেউ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে পারবে না। কারণ আরো আগেই চিকিৎসকরা তাদের নির্ধারিত কক্ষ ত্যাগ করেছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতো মেডিকেল অফিসারদের অবস্থাও একই। ২৪ জন মেডিকেল অফিসারের মধ্যে ১৯ জন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও দুই/তিনজনকে ছাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাউকে পাওয়া যায় না।
মেডিকেল অফিসার ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস শশী উপজেলার পুঁইছড়ি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা সেবা প্রদানের কথা থাকলেও তাকে অদৃশ্য কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে।
তার স্থানে একজন উপসহকারী মেডিকেল অফিসারকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে অলিখিতভাবে। যার কারণে উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পুঁইছড়ি ইউপির হাজার হাজার মানুষ। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ এসব অনিয়ম দেখভালের কথা থাকলেও তিনি যেন কিছুই দেখেন না। বরং তার মৌখিক অনুমোদনের প্রেক্ষিতেই দিনের পর দিন এসব অনিয়ম নিয়মরূপে প্রতিপালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ।
অন্যদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে তড়িঘড়ি করে হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় পরিচ্ছন্নতা অভিযান করা হয়। যা দুয়েকদিন পরিচ্ছন্ন থাকলেও আবারও আগের রূপে ফেরত গেছে।
হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় পুরুষ নারী ও শিশু ওয়ার্ডে ঘুরে দেখা যায়, দুর্গন্ধের জন্য ওখানে দাঁড়ানো দায়। এই পরিবেশেও কেউ বেডে, কেউ আবার মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। অসহায়, নিরূপায় মানুষেরাই মূলত এখানে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। নয়তো এই দুর্গন্ধে নতুন রোগের জন্ম হওয়ার মতো অবস্থা। হাসপাতালের টয়লেটের অবস্থাও খুবই অস্বাস্থ্যকর। সম্প্রতি ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। কিন্তু হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেখলে মনে হবে হাসপাতালই যেন ডেঙ্গু উৎপাদন কেন্দ্র।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, জুলাই ও আগষ্ট মাসে তিনজন করে, সেপ্টেম্বর মাসে ১০ জন এবং অক্টোবর মাসে ২৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন।
অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ জনবল সংকটের কথা জানিয়ে বলেন, আমাদের নিজস্ব দুইজন এবং পৌরসভার অধীনে চারজন পরিচ্ছন্নকর্মী রয়েছে। তাদের দিয়ে যতটুকু সম্ভব পরিষ্কারের চেষ্টা করা হয়।
জানা যায়, গত মার্চ মাসে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন ডা. সব্যসাচী নাথ। বাঁশখালী উপজেলায় যোগদান পরবর্তী তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দায়িত্ব অবহেলাসহ নানা অভিযোগ ওঠে।
অতীতেও চিকিৎসা অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে মামলা-মানবন্ধনও হয়েছে। অভিযোগের পাহাড় থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদের নির্বাচনী এলাকা রাঙ্গুনিয়ার বাসিন্দা হওয়ায় অদৃশ্য ক্ষমতাবলে তিনি বারবার পার পেয়ে যান বলে জনশ্রুতি আছে।
বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনিয়ম এবং দায়িত্ব অবহেলার ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ জানান, `বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রতিদিনই আসার কথা। যারা আসেন না তাদের শোকজ করা হয়। একজনের বেতনও আটকে দেয়া হয়েছে।` এসময় জনবল সংকট ও তার সীমাবদ্ধতা নিয়েও একটু প্রতিবেদন লিখতে এই প্রতিবেদককে আহবানও জানান।
এব্যাপারে জানতে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী মুঠোফোনে রূপালী বাংলাদেশকে জানান, আপনার কাছ থেকে অভিযোগ শুনেছি। এই অভিযোগ যাচাই করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন :