খুলনা জেলা ও বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় দীর্ঘদিন নির্বাচিত কমিটি না থাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে সব কার্যক্রম। জিমনেশিয়ামে ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি থাকলেও সবগুলোই প্রায় অচল। মানসম্মত নয় সুইমিংপুলটি। অবহেলা-অযত্নে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে ক্রীড়া সংস্থার মাঠ। প্রায় নয় একর জমির ওপর নির্মিত মহিলা ক্রীড়া সংস্থাটি খুলনা বিভাগের মধ্যে নারীদের খেলাধুলা ও ক্রীড়াবিষয়ক সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও নানান জটিলতায় অচল অবস্থায় পড়ে রয়েছে সংস্থাটি।
ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে চলেছে লুটপাট। যার দরুন সংস্থাটির বেহাল দশা। এভাবে চলতে থাকলে ক্রীড়াবিমুখ হওয়ার শঙ্কা দেখছেন সংগঠকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুলনা জেলা ও বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার দীর্ঘদিন নির্বাচিত কমিটি নেই। অ্যাডহক ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ এ কমিটি শুধু রুটিন ওয়ার্ক পরিচালনা করেছে। বিগত সময়ের কমিটিগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো তদন্ত হয়নি, বরং তারা বহাল তবিয়তে আধিপত্য বিস্তার করে আছে, যা দেখে হতাশ হয়ে পড়েছেন নতুন প্রজন্মের নারী ক্রীড়াবিদরা। বিগত সরকারের আমলে সরকারিভাবে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া খুলনা জেলা ও বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বাজেটের জন্য প্রস্তাবনা পাঠালেও অজ্ঞাত কারণে বাজেট অনুমোদন হয়নি। আওয়ামী সরকারের এই দীর্ঘ সময়কালে ক্রীড়া সংস্থার কোনো অগ্রগতি হয়নি। খুলনা বিভাগের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটি এখনো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
ক্রীড়াবিদ মহসিন হোসেন বলেন, খুলনা বিভাগের মধ্যে খুলনা জেলা ও বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ দপ্তরের কোনো উদ্যোগ নেই। অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দিয়ে নেই কোনো কমিটি। সরকারিভাবে কোনো আর্থিক সহায়তা নেই। বছরে দু-একবার খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই খেলাধুলার আয়োজন তরুণ-তরুণীদের ঢালাওভাবে আকৃষ্ট করতে পারে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই গার্ডরুমের অবস্থা জরাজীর্ণ। প্রায় এক যুগ ধরে একই অবস্থায় রয়েছে। মাঠের চারপাশ বন-জঙ্গলে রূপ নিয়েছে। দাপ্তরিক অপেক্ষমাণ কক্ষের কোনো গোছালো ভাব নেই। বাইরের জেলা থেকে খেলাধুলা করতে আসা নারীদের জন্য আবাসিক হল থাকলেও তা মানসম্মত নয়। নয়টি রুমে ৩৬ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। রুমগুলো ঘুরে দেখা যায় আলমারি, ওয়্যারড্রবগুলো ভাঙা পড়ে আছে। স্টিলের খাট থাকলেও রয়েছে ভঙ্গুর অবস্থায়। রুমের জানালায় নেই পর্দা। দেয়াল থেকে চুন খসে পড়ছে। ব্যায়ামাগারে স্বল্প কিছু জিনিসপত্র রয়েছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকার কারণে তা-ও অচল অবস্থা। অডিটোরিয়ামের ছাদের অংশ ভেঙে ভেঙে পড়ছে। কোনো সৌন্দর্য নেই বললেই চলে। টেবিল টেনিস রুম পড়ে আছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। সুইমিংপুলের অবস্থা খুবই করুণ। সুইমিংপুলের ওয়াটার রিফাইনিং মেশিন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। লবণাক্ত পানির এলাকা হওয়ায় রিফাইনিং মেশিন গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরও কখনো মেরামতের ব্যবস্থা করা হয়নি।
বর্তমানে খুলনা জেলা ও বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা সুইমিংপুলটি লিজ দিয়েছে। লিজ দেওয়ার বদৌলতে প্রচার-প্রচারণার কারণে অনেকে বর্তমানে সাঁতার শিখতে আসছেন। তবে পানি পরিবর্তন ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়ায় লিজ নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে অর্থসংকটে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সুইমিংপুল লিজ নেওয়া প্রতিষ্ঠান রেজাউল সুইমিং একাডেমির পরিচালক জি এম রেজাউল ইসলাম বলেন, কোনো বাজেট নেই। আর্থিক সহায়তা নেই। জোড়াতালি দিয়ে সুইমিংপুল চালাচ্ছি। প্রতি মাসে লিজের টাকাও পরিশোধ করতে হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে কিছু সাঁতারের শিক্ষার্থী পেয়েছি। তবে লবণাক্ত এলাকা হওয়ায় পানি নষ্ট হয় বারবার। পানি রিফাইনিং মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তা সচল করতে প্রায় ৮-১০ লাখ টাকা প্রয়োজন। যা এই দপ্তরের ফান্ডে এখন নেই। তাই তিন দিন পর পর সুইমিংপুলে পানি পরিবর্তন করেই চালাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, খুলনা জেলা ও বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থাটি সচল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারলে খুলনা বিভাগের ক্রীড়াপ্রেমীরা উপকৃত হবে। প্রতিষ্ঠানটি আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
সুইমিংপুলে আসা আসাদুজ্জামান জানান, খেলাধুলাবিমুখ হয়ে আজ তরুণসমাজ পথভ্রষ্ট হচ্ছে। খেলাধুলা মানসিক বিষণ্নতাকে দূর করে। আমাদের এই অঞ্চলের মেয়েদের খেলাধুলার প্রতি যথেষ্ট পরিমাণে আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চলেছে লুটপাট। খেলাধুলার দিক থেকে জাতীয় পর্যায়ে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকার নিয়ে যেতে পারেনি। মন্ত্রণালয় থেকে টাকা লুটপাট করে দেশের বাইরে পাচার করেছে। যার দরুন খুলনা জেলা ও বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার এই করুণ অবস্থা খুলনাবাসী দেখছে। এখন সংস্থাটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
তিনি আরো বলেন, দপ্তরের ভেতরের বিষয়ে জানি না। তবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়েছে এই সংস্থাটি।
খুলনা জেলা ও বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার উপপরিচালক মো. আবুল হোসেন হাওলাদার বলেন, আমি ২০২২ সালে এখানে যোগদান করি। যোগদান করে বেহাল অবস্থায় পাই। এই ভবনের পরিবেশও খুব খারাপ ছিল। আমি আমার বেতনের টাকা থেকে কিছু কিছু কাজ করিয়ে বসার মতো পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছি। এই রুমে কোনো পর্দা ছিল না।একজন ক্রীড়াপ্রেমী পর্দাগুলো কিনে দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, আশপাশ বন-জঙ্গলে ভরে উঠেছিল। তা পরিষ্কার করিয়েছি। বিভিন্ন সমস্যা, পুনর্নির্মাণ এবং নতুনভাবে উদ্যোগ নিয়ে সংস্থাটি পরিচালনার জন্য আর্থিক অনুমোদনের জন্য ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। এখনো সাড়া পাইনি। তবে খুব শিগগিরই সাড়া পাবো বলে আশা করি।
আপনার মতামত লিখুন :