ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

নাসিরনগরে আনসার সদস্যদের পূজার ডিউটির নামে লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্য

মো. বাবুল মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২৪, ০৩:৫৯ পিএম

নাসিরনগরে আনসার সদস্যদের পূজার ডিউটির নামে লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্য

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে শারদীয় দুর্গাপূজায় পূজা মন্ডপের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের কাছ থেকে প্রায় ৮ লক্ষ টাকার উৎকোচ আদায় করেছে একটি চক্র। এ চক্রের সাথে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সাধারণ আনসার সদস্যরাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও বিগত সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্যও সাধারণ আনসার সদস্যদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার ১২৮ টি পূজা মন্ডপের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের জন্য উপজেলায় আনসারদের পিসি, এপিসি ও সদস্য (পুরুষ ও মহিলা) নিয়ে মোট ৮৩২ জন নিয়োজিত রয়েছে। এদের মধ্যে পুরুষ ও মহিলা মিলিয়ে ৬৭২ জন সাধারণ সদস্যকে পূজা মন্ডপের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার ছয় দিনের চাকুরিতে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর অধিকাংশ সদস্যকেই তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য ১২শ টাকা করে ঘুষ দিতে হয়েছে। ঘুষ আদায়ের জন্য নাসিরনগর আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের দল নেতা-নেত্রীদের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রতিনিধি। এসব প্রতিনিধির মাধ্যমে আদায়কৃত অর্থ জমা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের দল নেতা-নেত্রীদের হাতে। পরে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ বাটোয়ারা হয় সেই অর্থ। ঘুষ আদায়ের পাশাপাশি আনসার সদস্যদের ভুয়া তালিকা করে অর্থ আত্নসাত, ভুয়া বিল প্রণয়ন, অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ বিহীন লোক নিয়োগ, একই ব্যক্তিকে একাধিক মন্ডপে দায়িত্ব প্রদানসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। পূজায় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে তালিকাভুক্ত আনসার সদস্য নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের টেকানগর গ্রামের মো. আবুল বাসার বলেন, “আমাদের বলছে ১২শ করে টাকা দেওয়া লাগবে পরে আমরা দিয়েছি ১২শ। আমি এখন দাঁতমন্ডল থাকি, এই গ্রামের সবার থেকে টাকক নিয়েছে।

দাঁতমন্ডল গ্রামের বাসিন্দা আজহারুল ইসলাম বলেন, “আমাদের গ্রামের (দাঁতমন্ডল দক্ষিণপাড়া) মধ্যে তিনটা দল আছে, প্রতিটা দলে ২৪ জন করে লোক আছে। একটা দলের দায়িত্বে সড়ক পাড়ার হোসনা, আরেকটা দলের দায়িত্বে খাঁ বাড়ির শাফাউল্লাহ। এরা লোক নিয়ে দেয়। বিনিময়ে ১২শ করে টাকা নেয়। উত্তর  গ্রামেও এমন দুই-তিনটা দল আছে। আমাদের পাড়ার অনেক লোক আছে এরা টাকা না দেওয়ায় ডিউটিতে যাইতে পারেনি, যারা টাকা দিয়েছে তাদের এরারে ডিউটিতে নিয়েছে। আমার ভাইদের থেকেও ১২শ করে টাকা নিয়েছে। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় লাখ খানেক টাকা নিয়ে গেছে। আমরা এটার প্রতিবাদ জানাই।”

টাকার বিনিময়ে পূজার ডিউটিতে তালিকাভুক্ত হওয়া আশরাফ উদ্দিন বলেন, “আমার কাছ থেকে ১২শ টাকা নি ইসলিমা। আমারে বলেছে ১২শ টাকা লাগবে আমি ১২শ টাকা উনার বাড়িতে নিয়ে দিয়ে আসছি। সবার থেকেই নিয়েছে। এখন আমারে বলেছে নিয়ে দিয়ে আসা  লাগবে। আমি  দিয়ে আসছি। সবাই দিচ্ছে তাই আমিও ৩/৪ দিন আগে ১২শ টাকা দিয়ে আসছি।

ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তালিকাভুক্ত হতে না পারা সেলিম মিয়া বলেন, "পূজার ডিউটির টাকা নিতে আসছিল, পরে বলছে ১২শ টাকা দিতে হবে। আমরা ১২শ টাকা দিতে রাজি হয়নি বিধায় আমাদের ডিউটিতে নেয়নি। যারা টাকা দিয়েছে তাদেরকে নেওয়া হয়েছে। গত নির্বাচনেও আমি ডিউটি করছিলাম, ১২শ টাকা দিয়ে।

নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের আব্দুল ওয়াসিম বলেন, "আমি সবসময় আনসারদের ডিউটিতে যাই। গতবার পূজার ডিউটির জন্য ৫শ টাকা নিয়েছে জাতীয় নির্বাচনে দিয়েছি ১ হাজার। এবার টাকার জন্য আইসা বলে ১২শ লাগবে। আমি বলেছি দিনদিন টাকার অংক বারে কেন। টাকাও দিব না, ডিউটিও করব না। ইসলিমা বলছে এই টাকা অফিসে দেওয়া লাগে, এরে-ওরে দেওন লাগে।"

গ্রাম পর্যায়ে টাকা আদায়কারীদের একজন হোসনা বেগম জানান, আমরা টাকা উঠিয়ে দলনেত্রী ইসলিমা আফার কাছে দিয়েছি। আমরা গরীব মানুষ, কাজ করে খাই। দলনেত্রী বলেছে টাকা তুলে দেওয়ার জন্য, আমি ২৬ জনের টাকা তুলে ইসলিমা আফার কাছে দিয়েছি। এরা সবার কাছ থেকেই টাকা নেয়। অনেক গ্রুপ আছে, অন্য গ্রুপে তারা ও টাকা দেয়। গত পূজায় ৫শ টাকা করে নিয়েছিলাম। গত  উপজেলা নির্বাচনে ও জাতীয় নির্বাচনে ১ হাজার টাকা করে নিয়েছে।

নাসিরনগর সদর ইউপি দলনেত্রী মোছা: ইসলিমা বেগম জানান, যাদের তালিকায় নাম দিতে পারিনি তারাই এসব বলছে। পরে, ঘুষের বিনিময়ে তালিকাভুক্তদের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সরাসরি দেখা করতে চাইলেন।

নাসিরনগর উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান জানান, এবছর ১২৮ টি পূজা মন্ডপে ৮২৬ জন আনসাররা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি শুনেছি ইউনিয়ন পর্যায়ে যারা রয়েছে তারা হয়ত এ গুলো করেছে,আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছি, যারা এ কাজের সাথে সম্পৃত্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমান্ড্যান্ট মো. মনিরুজ্জামান জানান, পূজার বাছাইয়ের বিষয়ে শুরুতেই তাদেরকে কঠোরভাবে বলা হয়েছে, কোনো ধরণের লেনদেন যারা করবে এর দায় দায়িত্ব সে বহন করবে। ডিজি মহোদয়ও এবিষয়ে কঠোর ভাষায় সতর্ক করেছেন। আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব।

আরবি/জেডআর

Link copied!