ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

নওগাঁয় শত বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাঁশির গ্রাম

খোরশেদ আলম রাজু , নওগাঁ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৪, ০৮:২৭ পিএম

নওগাঁয় শত বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাঁশির গ্রাম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

চিরন্তন সুর বাঁশি, পৈৗরানিক উপাখ্যানে কৃষ্ণের বাঁশির সুরে রাঁধা বেরিয়ে এসেছিল তার কুঞ্জবনে। কিন্ত কৃষ্ণের সেই অমৃত সুর নাহলেও, পোঁ-পাঁ সুরের মায়ার বাঁধনে বেঁধে রেখেছে শত বছরের দেবীপুর গ্রাম। বাঁশিকে নিয়ে আছে অসংখ্য গান, কবিতাসহ সাহিত্যের ছন্দরস। তবে বলছিলাম নল বাঁশির কথা। প্রায় শত বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে আজও চলমান রয়েছে বাঁশি কারিগরদের এ পেশা।

বাংলাদেশের কৃষিখ্যাত ধান, আমে সুপরিচিত সীমান্তবর্তী উওরের জেলা, নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর তীর ঘেষাঁ সবুজ পল্লবে সুনিবিড় দেবীপুর গ্রাম। ভোর বেলা আজানের ধ্বনি কিংবা মোরগের ডাঁকে ঘুম না ভাঙলেও সেই চিরচেনা নল বাঁশির পোঁ-পাঁ শব্দে ঠিকই ঘুম ভাঙে দেবীপুর গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারে। এ গ্রামে যে যেই পেশার সাথেই জড়িত থাকুকনা কেন পাশাপাশি প্রতিটি পরিববারে বাঁশির কাজ কমবেশী লক্ষণীয়। 

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে সওোর উর্দ্ধ আফসার উদ্দিন রূপালী বাংলাদেশ কে বলেন, দেবীপুর সংলগ্ন উড়াপাড়া পাশাপাশি গ্রাম, এ দুটি গ্রামে প্রায় তিনশত পরিবারের বাস, এখানে প্রায় অধিকাংশ পরিবার এ পেশার সাথে জড়িত। সর্বপ্রথম কে এই পেশা নিয়ে এসেছিল এমনটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রায়ত আলেক মন্ডল প্রথম এ কাজের যাত্রা শুরু করে যা আজ অবধি চলমমান রয়েছে।

বাঙালীদের হৃদয়ে উৎসব যেন এক আনন্দঘন আমেজ তাই বছরের পহেলা দিন হিসেবে বৈশাখী মেলা, ঈদ দূর্গাপূজা সহ নানা আচারনুষ্ঠানে ছোট সোনামুনিদের একটু বিনোদনের জন্য মেলায় নল বাঁশির পশরা চিরায়ত। কারিগররা বলেছেন দেবীপুর গ্রাম থেকে প্রতি বছর প্রায় ২২ কোটি টাকার নল বাঁশি তৈরী করা হয় যার উৎপাদন ব্যায় ৩২ কোটি টাকা এবং পাইকারী বিক্রয় মূল্য প্রায় ৪২ কোটি টাকা। তবে বছরের কিছু কিছুু সময় এর কমবেশী হয়ে থাকে। কিছু কারিগরদের ভবিষৎ চিন্তা এই কুুটির শিল্পকে দেশের চাহিদা  মিটিয়ে রপ্তানিমুখী করার।

জেলা শহরের পার্শ্ববর্তী তিলকপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত দেবীপুর গ্রামে প্রবেশ করতে প্রথমেই চোখে পড়বে রাস্তার দু’ধারে আখ বৃক্ষের আদলে নল বাঁশির চিরল পাতার হাতছানি, তার একটু এগোলেই প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠান ও বারন্দায় বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষ নানা উপকরণ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করার চিত্রও চোখে পরার মতো। বাঁশি তৈরী করতে প্রথমে ক্ষেত বা জমি থেকে কাঁচামাল হিসেবে নল কেটে বাড়ি নিয়ে এসে তা দুই থেকে তিনদিন রোদে শুকানোর পর প্রায় ১২ টা ধাপ পেরিয়ে একটি পূণাঙ্গ বাঁশির রূপ দেয়। উৎপাদন করতে এ পেশায় নারীদের ভুমিকায় বেশী তবে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে পুরুষরাই এগিয়ে। 

দেবীপুর গ্রামের বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমার ব্যবসার বয়স প্রায় ৪০ বছর এ পেশা আমাদের পূর্বপুরুষরা করেছে আমিও করছি তবে আগের  মতো ব্যবসায় আর লাভ নেই, কারন হিসেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন কয়েক বছর করোনা মহামারী থাকার কারনে ব্যবসা বন্ধ ছিল করোনা গত হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারনে কোন জায়গায়  তেমন কোন অনুষ্ঠান বা মেলা হয়না। এছাড়া বাঁশি তৈরীর কাঁচামাল থেকে শুরু করে প্রতিটি সরঞ্জামের দাম বেড়েছে সেই হিসেবে পাইকারী মূল্য তেমন বৃদ্ধি পায়নি। সাদা বাঁশি তৈরিতে খরচ হয় ১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২ টাকা সেটি পাইকারি বিক্রয় হয় ২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৩ টাকায়। বাঁশির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করতে বেলুন ও রঙিন জড়ি পেছিয়ে খরচ পরে ৫ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৬ টাকা সেটি পাইকারি বিক্রয় হয় ৬ টাকা ৫০ পয়সা বা ৭ টাকায়। বাঁশি কারিগর সুমন বলেন সাজিয়ে গুছিয়ে মানসম্পন্ন পূনাঙ্গ বাঁশি তৈরি করে নিজ হাতে বিক্রয় করলে একেকটি ১৫-২০ টাকায় বিক্রয় করা যায় তবে এটা সকলের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠেনা। দেশের বিভিন্ন জেলা হতে অনেক পাইকাররা সরাসরি দেবীপুর গ্রামে বাঁশি ক্রয় করতে আসেন। এছাড়াও কারিগররা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলায় নিজে গিয়ে বা কুরিয়ারের মাধ্যমে পণ্য পৌঁছে দেয়।

বাঁশি কারিগররা গৌরবের সাথে বলেন, আমাদের এই ক্ষুদ্র পেশার দ্বারা দেশের বিভিন্ন জেলায় নওগাঁর  এই ছোট্ট গ্রামের পরিচয় বহন করে। দেবীপুর গ্রামের প্রায় প্রতিটি নারী তাদের সাংসারিক কাজের পাশাপাশি সাদা বাঁশিতে বেলুন লাগানো রঙিন জড়ি পেঁছানো সহ নানাধাপে কাজ করে বাড়তি আয় করে থাকে। 

এই গ্রামের বাসিন্দা  হামিদা বেগম বলেন, হামার বাড়ির গৃহস্ত অনেক আগে মরে গেছে, হামি এই কাজ করেই সংসার চালায়, টানা কাজ করলে দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কামায় করা যায়। বছরের সবসময় বাঁশি তৈরি করা হলেও বৈশাখ মাসে মেলা কে সামনে রেখে ফাল্গুন, চৈত্র মাসে বেশী পরিমান বাঁশি উৎপাদন করা হয়। সে সময় পরিবারের প্রায় সকল নারী পুরুষ দিনরাত ব্যাস্ত সময় পার করে।

নওগাঁ জেলা বিসিক এর উপ-ব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং যারা ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তুলেছে তাদের জন্য বছরে চার বার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকি, যারা আগ্রহী তারা আবেদনের মাধ্যমে এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে। তবে দেবীপুর বাঁশি শিল্পের কোন কারিগররা আমাদের এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেনি তারা যদি আগ্রহী হয় তাহলে আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নারী উদ্যোক্তাদের ৫% এবং পুরুষ উদ্যোক্তাকে ৬% সুদে ঋন প্রদান করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগিয়ে গেলে তাদের এই ক্ষুদ্র শিল্পটি আরো প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!