ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

রাইস মিলের বর্জ্যে কয়লা হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ

মেহেরপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৪, ০৯:২১ পিএম

রাইস মিলের বর্জ্যে কয়লা হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

মেহেরপুরে রাইস মিলের কালো ধোঁয়া ও বর্জে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। ঘরবাড়ি, গাছপালা সব ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কালো ছাই আর ধুলায়। মিলের আশেপাশের পুকুর ও কৃষিজমি পচা পানি আর পোড়া তুষ-ভুসিতে জমাট বাঁধা নর্দমায় পরিণত হয়েছে। এতে অসহনীয় জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে। অটো রাইস মিলটি একটি ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান হলেও এর নাই কোন বর্জ্য শোধনাগার। সারাবছরই দূষিত বায়ু আর পানিতে বসবাস এখানকার জনগোষ্ঠীর। ফসলের মাঠেও দূষিত পানির বিড়ম্বনা।

সরজমিনে যেয়ে দেখা গেছে, মিলের দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানি ড্রেন ও পাইপের মাধ্যমে সরাসরি ছেড়ে দেয়া হচ্ছে পার্শবর্তী কৃষি জমিতে, এমনকি মাছ চাষের পুকুরেও। ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, মরে ভেসে উঠছে মাছ। কৃষি কাজে শ্রমিক পাওয়া যায় না। জমিতে দূষিত পানি থাকায় চর্ম রোগের ভয়ে হাত দিতে চান না তারা। দূষিত পানির সঙ্গে ধানের কুড়া ও ছাই থাকায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুকুর। মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা প্রধান সড়কের পাশে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ফেলে রাখা হয়েছে অটো রাইস মিলের ছাই (ধানের পোড়া তুষ)। আর কেমিক্যাল মিশ্রিত গরম পানি ও বর্জ্য ফেলা হচ্ছে আশেপাশের কৃষি জমি ও পুকুরে। এতে  পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ডায়মন্ড অটো রাইস মিলের বর্জ্য, ছাই, ধোয়া চারপাশের পরিবেশ নষ্ট করছে। এতে চোখের নানা সমস্যা, অ্যালার্জী, মারাত্মক শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন স্থানীয়রা। মিলের উড়ে যাওয়া ছাই ও বর্জের কারণে কোমলমতি শিশুসহ সাধারণ মানুষ চোখের সমস্যাতেও ভুগছেন। মিলের ছাই মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা প্রধান সড়কে পাশে উন্মুক্ত ভাবে ফেলে রেখে পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। বর্জের কারণে ফসলি জমির চাষ করা ফষল নষ্ট হচ্ছে। মিলের মালিককে একাধিকবার বলার পরও তিনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ও পরিবেশ অধিদফতর কুষ্টিয়া বরাবর লিখিত অভিযোগ করেও কোন ফল পাওয়া যায়নি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

স্থানীয় কৃষক আব্দুর রাজ্জাক দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‍‍`আমার ২৫ কাঠা জমিতে এখনো ধান আছে। মিল থেকে বর্জ্য ও গরম পানি ছাড়াতে আমার ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এর আগেও একাধিক বার এরকম করেছে। আমি জেলা প্রশাসক ও কৃষি অফিসে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন ফল পাইনি।

‍‍`পার্শ্ববর্তী একটি গ্যারেজের মোটর মেকানিক মোঃ আনোয়ার দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‍‍` রাস্তার পাশে ফেলা ছাইয়ের কারণে আমরা শারীরিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি একইভাবে ব্যবসা চালিয়ে যেতেও সমস্যা হচ্ছে। এখানে কোন গাড়ি রাখলে কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়িতে ছাইয়ের স্তর পড়ে যায়। বাতাসে ধানের পোড়া তুষ চোখে প্রবেশ করাতে আমাকে তিনবার হাসপাতালে যেয়ে চোখ পরিষ্কার করে আনতে হয়েছে। পরবর্তীতে চোখের ড্রপ ও এন্টিবায়োটিকও ব্যবহার করতে হয়েছে। আমি গরিব মানুষ। আমি চাই শিল্পপতি হাবিব ব্যবসা করুক তবে পরিবেশের দিকে এবং পার্শ্ববর্তী ব্যবসায়ী ও অন্যান্য মানুষের জন্য সমস্যা সৃষ্টি না করে।‍‍` এ সময় রাস্তায় মোটরসাইকেল চালানো অবস্থায় চোখে ধানের পোড়া তুষ পড়া এক ভুক্তভোগীকে মোটরসাইকেল থামিয়ে চোখ তুলতে দেখা যায়। তার সাথে কথা বলতে গেলে তিনি রাস্তার পাশেই পোড়া ধানের তুষ ফেলা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। একই সাথে তিনি বলেন ইতোপূর্বে এই ধানের তুষ চোখে পড়ে কয়েকজন মোটরসাইকেল চালক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।

ডায়মন্ড অটো রাইস মিলের পাশে কিয়াম উদ্দীনের একটি গাড়ি ধোয়ার ওয়ার্কশপ রয়েছে। তিনি বলেন, মিলের ছাইয়ের কারনে গাড়ি ধোয়া মাত্র আবার ময়লা হয়ে যায়। এভাবে চললে আমার পক্ষে আর ব্যবসা চালানো সম্ভব হবে না।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও মৎস চাষী সৈয়দ সোহেল দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‍‍`মিলটির পাশেই আমার একটি পুকুর রয়েছে। পাশাপাশি আমার মোটর ওয়ার্কশপের ব্যবসা রয়েছে। মিল থেকে কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি আমার পুকুরে ছাড়ার কারণে চার দফা আমার পুকুরের সব মাছ মরে গেছে। এতে আমি প্রায় ৮ লক্ষাধিক টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমি ক্ষতিপূরণ চাই না, শুধু চাই নির্বিঘ্নে আমরা যেন ব্যবসা করতে পারি। ডায়মন্ড অটো রাইস মিলের মালিক হাবিবুর রহমানকে অভিযোগ দিলে তিনি হুমকি ধামকি দিয়ে বলেন তোরা যা পারিস করে নে। প্রশাসনে অভিযোগ দিয়েও কোন ফল পাওয়া যায় না। কারণ তার টাকা আছে। টাকা দিয়েই সবাইকে সে ম্যানেজ করে ফেলে। তিনি কালবেলাকে একটি ভিডিও সরবরাহ করেন,যেখানে দেখা যায় মিল থেকে কিভাবে পুকুরে কেমিক্যাল মিস্ত্রিত পানি ফেলা হচ্ছে এবং তার পুকুরের মরা মাছ।

‍‍`পরিবেশ অধিদফতর কুষ্টয়ার উপ-পরিচালকের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়ার পর কথা বলেন দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর মো. মালেক শেখ। তিনি বলেন, মেহেরপুরের ডায়মন্ড অটো রাইস মিলের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা থেকে। একইসাথে তিনি পরামর্শ দেন কয়েকদিনের মধ্যে মেহেরপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরু হবে। তখন সেখানে আপনারা বিষয়টি জানালে ভালো হবে। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করে কিভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেলো সে বিষয়ে জানতে ডায়মন্ড অটো রাইস মিলের মালিক হাবিবুর রহমানকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ডায়মন্ড অটো রাইস মিল থেকে রাস্তায় ও পুকুরে ফেলা বর্জ্যের নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হয় মেহেরপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে। 

সেগুলি পরীক্ষা নিরীক্ষার পর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. সউদ কবির মালিক দৈনিক রূপালি বাংলাদেশকে বলেন, ‍‍`ধানের পোড়া তুষ ও দূষিত পানির স্যাম্পল আমি দেখেছি। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি স্বরূপ।‍‍`

তিনি আরো বলেন, ‍‍`এই ছাই উড়ে মানুষের চোখে যেয়ে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। অ্যাজমা রোগীদের জন্য এটি অনেক ভয়ঙ্কর। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারখানার ভেতরেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট স্থাপন করা উচিত। এছাড়াও বাইরে উন্মুক্ত জায়গায় না ছড়িয়ে মাটি খুঁড়ে পুঁতে ফেলা যেতে পারে।‍‍`

আরবি/জেডআর

Link copied!