সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে আবদুল মোমেন। তিনি লোকচক্ষুর সামনে ছিলেন একেবারেই পাক্কা মুমিন। সবাই জানত দুর্নীতি করেন না। ছুঁয়েও দেখেন না। এমনকি উন্নয়ন কাজেও কোনো কমিশন নেন না। তিনি সিলেটের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। একেবারে সিলেটপ্রেমী একজন সাচ্চা মানুষ। কিন্তু লোকমুখে চাওড় ছিল, তিনি নিজে সরাসরি দুর্নীতি না করলেও ঘুরিয়ে ঠিকই টাকার-সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ঘুষ-কমিশন সবই খেয়েছেন। কমিশন আর ঘুষের টাকায় তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হয়েছে রিষ্টপুষ্ট। সিলেট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী মোমেনের মুখোশের আড়ালের আসল চিত্র এমনটাই।
ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন কোনো সেক্টর নেই যেখান থেকে ড. মোমেন কমিশন নেননি। সিলেটে উন্নয়ন প্রকল্প মানেই ছিল তার একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন লাভ। বিশেষ করে বিদেশি কোম্পানির জন্য দেশে উন্নয়ন কাজ পাইয়ে দিতে তদবির বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মোমেন। তবে তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না। নিজের হাতে সব ঘুষ বা কমিশনের টাকা গ্রহণ না করলেও তার ক্যাশিয়ার ছিলেন নিজের স্ত্রী। তিনিই মূলত পর্দার আড়ালে থেকে তার রাজত্ব নিয়ন্ত্রণ করতেন। লেদদেন হতো তার মাধ্যমেই, তার অ্যাকাউন্টেই।
সিলেটে এমন কথা প্রচলিত ছিল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনকে কোনো কিছুতে রাজি করাতে হলে আগে তার স্ত্রীকে রাজি ও খুশি করতে হবে। তদবিরের জন্য প্রথমে ধরনা দিতে হতো স্ত্রীর অন্দরমহলে। কমিশন বাণিজ্য হতো তার মাধ্যমেই। সিলেটে বিষয়টি ছিল অপেন সিক্রেট। একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে দুদক বা কোনো সরকারি সংস্থা তার দুর্নীতি নিয়ে এখনো কোনো তদন্তে নেমেছে বলে শোনা যায়নি।
সূত্র জানায়, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মোমেনের ভাই হলেও সিলেটে তিনি ‘আলগা মোমেন’ নামে পরিচিত ছিলেন। নিজেকে সবকিছু থেকে আলাদা জাহির করে তা প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তার। নিজে কিছু করছেন, এমন প্রমাণ রাখতে সব সময় ছিলেন নারাজ। ব্যবহার করতেন স্ত্রীকে। এসব কারণে সিলেটের স্থানীয়রা তাকে ‘আলগা মোমেন’ নামে ডাকতেন। সিলেটের স্থানীয় উন্নয়নের ২৫ শতাংশ কমিশন বাধ্যতামূলকভাবে তাকে দিতে হতো। কোনো কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের এই কমিশন আগে পরিশোধ করলেই তার ডিও লেটার নিয়ে কাজ আনতে পারতেন।
অভিযোগ আছে, স্ত্রী সেলিনা মোমেন সিলেট পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতি মাসে গুনতেন ৩০ লক্ষাধিক টাকা। পাসপোর্ট অফিসের টোকেন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন সোর্সকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতির যে রাজত্ব তৈরি করা হয়েছিল তার হিসাব প্রতি মাসে পাইপাই করে দিতে হতো সেলিনা মোমেনকে। নিয়োগপ্রাপ্ত এজেন্ট দিয়ে তিনি এ কাজ করতেন। চোরাচালানির রুট হিসেবে ব্যবহারের জন্য সিলেট এয়ারপোর্ট থেকেও আসত একটি অংশ। সবসময় তাকে রাজি ও খুশি রাখতেন সিলেট এয়ারপোর্টের কর্তারা। সিলেট এয়ারপোর্ট থেকে কোম্পানিগঞ্জ রাস্তায় ৫৬০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে একাধিক সূত্র থেকে।
আর এই কাজটি করেছেন মোমেন ও তার স্ত্রী দুজনে মিলেই। গত বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন এবং সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অর্থের জোরে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ছিল ড. মোমেনের বিরুদ্ধে। নিজের স্বামীর হয়ে সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক রাসেল হাসান ও জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুনের মাধ্যমে ৩ কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন করেছেন সেলিনা মোমেন। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন মহলে আলোচনার খোরাক হয়। সিলেট সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন বরাদ্দ আনতে হতো তাকে ছুঁয়ে। সব কাজেরই কমিশন পেতেন তিনি। এমনকি চিনি চোরাচালান থেকেও তাকে মাসে একটি ভাগ দেওয়া হতো। যা বণ্টন করতেন সাবেক জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন নিজে। তিনিই ড. মোমেনের ভাগ তার কাছে পৌঁছে দিতেন।
সূত্র জানায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে বিদেশি কোম্পানির জন্য তদবির বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ড. এ কে আবদুল মোমেন। অভিযোগ আছে, ঢাকা-সিলেট চারলেন প্রকল্পের জন্য চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির কাছ থেকে নেওয়া ১৫০ কোটি টাকা নিয়েছিলেন তিনি। সেই টাকার বিনিময়ে তিনি ওই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেছিলেন তিনি। সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চ মহলে দফায় দফায় ধরনা দিয়েছেন। কোনোভাবেই যাতে চায়না কোম্পানির চুক্তি বাতিল না হয় সেজন্য তিনি দফায় দফায় চিঠি লিখেছেন সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে। এ রকম একটি চিঠির কপি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশও হয়। আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ইকবাল মাহমুদ বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করার পর হইচই শুরু হয়।
সূত্র জানায়, ড. এ কে আব্দুল মোমেনের লুটপাট, দুর্নীতির শুরু এমপি-মন্ত্রী হওয়ার আগ থেকেই। তার ভাই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের শেষ মেয়াদে আমেরিকা থেকে দেশে ফেরেন তিনি। তার লক্ষ্য সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচন করা। এ সময় সরলপ্রাণ অর্থমন্ত্রী মুহিত তার রাষ্ট্রীয় কাজের ব্যস্ততার জন্য সিলেটের উন্নয়ন কাজ তদারকি করতে ছোটভাই মোমেনকে বিশেষ দায়িত্ব দেন। আর এই মওকাকে টাকা বানানোর ধান্দায় উপযুক্ত ব্যবহার করেন মোমেন ও তার স্ত্রী সেলিনা। এ সময়ে ঢাকা-সিলেট চারলেন প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দিতে চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে অসাধু চুক্তি শুরু করেন ড. মোমেন। বিশাল অংকের ঘুষের শর্তে অবিশ্বাস্য নির্মাণব্যয়ে কোম্পানিটিকে কাজ পাইয়েও দেন মোমেন। আপন বড় ভাই অর্থমন্ত্রী এবং একনেকের বিকল্প চেয়ারম্যান হওয়ায় ডিলটি তার জন্য বেশ সহজ ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম অবিশ্বাস্য নির্মাণব্যয় এটি। যার প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৮১ কোটি টাকা।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সর্বমোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা। ঢাকায় চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের দিনই ঘুষের টাকার পেমেন্ট হিসেবে ১৫০ কোটি টাকা মোমেনের বাসায় পাঠায় চায়না কোম্পানিটি। ভাগ না পেয়ে ক্ষিপ্ত ওবায়দুল কাদের অর্থমন্ত্রী মুহিতের কাছে নালিশও করেন। এ ছাড়া সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোমেনের ঘুষ নেওয়ার তথ্য ফাঁস করেছিল খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এভাবে বিনা ভোটের এমপি ড. মোমেন শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন। তবে ড. মোমেন নিজে সেই টাকা দিয়ে দেশে কোনো কিছুই করেননি। সব টাকাই ঢুকেছে তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে। তিনি স্ত্রীকে দিয়েই অঢেল টাকার মালিক হয়েছেন। এই অর্থ লগ্নি করেছেন আমেরিকায়। বর্তমানে সেলিনা মোমেন আমেরিকায় অবস্থান করছেন। ৫ আগস্টের আগে সেলিনা মোমেন আমেরিকায় চলে গেলেও দেশ ছাড়তে পারেননি ড. মোমেন। তিনি আত্মগোপন করে আছেন এখনো।
এদিকে জুলাই বিপ্লবের পর ড. মোমেনের বিরুদ্ধে সিলেটে কয়েকটি হত্যা মামলা হয়েছে। প্রথম মামলাটি হয় ২১ আগস্ট। সিলেটে ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলা ও গুলিবর্ষণের অভিযোগে আব্দুল মোমেনসহ ৬৪ জনের বিরুদ্ধে সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন জুবেল আহমদ স্বপন নামে এক ব্যক্তি। শেষ মামলাটি হয় গত ১২ নভেম্বর রাতে কোতোয়ালি থানায়। বিস্ফোরক ও হত্যাচেষ্টা মামলায় ড. এ কে এম আব্দুল মোমেন ছাড়াও তার স্ত্রী সেলিনা মোমেনকেও আসামি করা হয়। মামলাটি করেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুরের সদরপুর গ্রামের বাসিন্দা তফুর আলীর পুত্র মো. আলাল মিয়া।
আপনার মতামত লিখুন :