ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

ঈশ্বরদীতে পাঁচ বছরে ফসলি জমি কমেছে ৩ হাজার হেক্টর

গোপাল অধিকারী, ঈশ্বরদী

প্রকাশিত: নভেম্বর ৭, ২০২৪, ০৫:৫৭ পিএম

ঈশ্বরদীতে পাঁচ বছরে ফসলি জমি কমেছে ৩ হাজার হেক্টর

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঈশ্বরদীতে দিন দিন কমতে শুরু করেছে আবাদি জমির পরিমাণ। এসব জমির মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে শিল্প-কারখানা, বাড়ি-ঘর, ইটভাটা, রাস্তা-ঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। কাটা হচ্ছে পুকুর। ফলে আবাদি জমিতে কৃষি পণ্য উৎপাদনে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি বিভাগের আশঙ্কা, এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ব্যাপক খাদ্য সংকটে পড়তে হবে এ উপজেলাকে।

ঈশ্বরদী পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন সভ্যতা ও ঐতিহ্যে লালিত জেলা, যা পাবনা জেলার অংশ হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই পদ্মার স্নিগ্ধ জলে বিস্তৃত কৃষি জমি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে রেলওয়ের উন্নয়নের মাধ্যমে ঈশ্বরদী হয়ে উঠেছিল দেশের অন্যতম একটি যোগাযোগ কেন্দ্র, যা ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিল। এই অঞ্চলের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পদ্মা নদীর পার্শ্ববর্তী অবস্থান এটিকে কৃষি, শিল্প এবং অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ করেছে। ঈশ্বরদী বর্তমানে দেশের অন্যতম
শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান এ জেলার অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

২৩৬.৬৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের উপজেলাটি ১টি পৌরসভা, ৭টি ইউনিয়ন এবং ১২৩টি গ্রাম রয়েছে। উপজেলায় মোট ভূমির পরিমাণ ৫৮ হাজার ৪৭৫ একর। এর মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ৩৯ হাজার একর। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুসারে, ঈশ্বরদী উপজেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৫১ হাজার ৪৩৩ জন।

এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে বাস করেন প্রায় ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৪৫ জন এবং শহরাঞ্চলে বাস করেন প্রায় ৭৩ হাজার ৭৮৮ জন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঈশ্বরদী উপজেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৮৯ হেক্টর। এর মধ্যে এক ফসলি জমির পরিমাণ ৪৫০ হেক্টর, দুই ফসলি জমির পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ হেক্টর ও তিন ফসলি জমির পরিমাণ ১৪ হাজার ৯৩৯ হেক্টর। এ উপজেলায় ১৫ শতাংশ মানুষ সরাসরি কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। এসব মানুষের জীবন-জীবিকা চলে কৃষি উৎপাদন ও কৃষি বিপণন থেকে। জনসংখ্যা অনুযায়ী মোট খাদ্য শস্যের চাহিদা গড়ে ৫৫ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন, উৎপাদন হচ্ছে ৩০ হাজার ৮৮০ মেট্রিক টন।

উপজেলায় ২০১৮ সালে আবাদি জমির পরিমান ছিলো ২১ হাজার ৪৩৮ হেক্টর। ২০২৪ সালে ১৭ হাজার ৮৮৯ হেক্টর। গত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৫৪৯ হেক্টর ফসলি জমি কমেছে। শিল্পকল-
কারখানা, ইটভাটা, ঘরবাড়ি তৈরি ও আবাসন প্রকল্পের জন্য জমি ক্রয়/দখল করে বালু দিয়ে ভর্তিকরণ ইত্যাদিই জমি কমে যাওয়ার কারণ । এ উপজেলায় কৃষকরা বেগুন, করলা, পটল, শসা, বরবটি, চিচিংগা, ঝিঙা, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, লালশাক, ডাটাশাক, কচু, আলু, ঢেঁড়স, পেঁপেসহ মৌসুম ভিত্তিক বিভিন্ন সবজির চাষ করেন। এছাড়া আউশ, আমন, রোপা আমন, বোনা আমনধানসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদিত হয় এ উপজেলায়।

প্রবীণ নাগরিক প্রাক্তন অধ্যপক উদয় নাথ লাহিড়ী বলেন, “ইচ্ছেমতো জমির ব্যবহার বাড়ছে। চিহ্নিত করা যাচ্ছে না কৃষি ও শিল্পের জমি। রাতারাতি খাল, বিল, ডোবা নালা ভরাট হচ্ছে। যেখানে বছরে দু’বার ফসল উৎপাদন হতো। বর্ষায় জমতো থৈ থৈ পানি। এলাকার সাধারণ মানুষ এই প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ সংগ্রহ করতো, যা ছিল জীবিকারও উৎস। এখন আর এমন কিছু দেখা যায়না। এসব ফসলি জমিতে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হলেও, এসকল বেশিরভাগ জমিতে কৃষক তিন বার ফসল ফলানো হতো। এমন ফসলি জমিতেও শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে নানা কৌশলে।”

ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর এস এম রবিউল ইসলাম বলেন, “নগরায়ন, শিল্পায়ন ও গ্রামে অপরিকল্পিতভাবে আবাসন নির্মাণের ফলে দ্রুত আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আবাসন নির্মাণ করতে হচ্ছে। তবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এখনই আবাদি জমি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রুত ভূমি রক্ষায় সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ না করলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিবে।”

পাকশী রেলওয়ে ডিগ্রি কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বলেন, “ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে আবাদি জমিতে অবাধে বাড়িঘর না করে একই স্থানে অনাবাদি জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে অধিক লোকের আবাস সংস্থান করা সম্ভব। তা হলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খাদ্যাভাবের সম্মূখীন হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিলে কৃষি জমি রক্ষা করা সম্ভব।”

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, আবাদি জমি কমে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্য উদ্বেগের। ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমে সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে যাতে তারা আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও টেকসই কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ করেন। 

তিনি আরও বলেন, কৃষি জমির সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। আমরা কৃষকদেরকে আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করতে সহায়তা করছি। কৃষি সেক্টরের উন্নয়নে স্থানীয় সম্প্রদায়ের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ, এবং তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাব। ]

আবাদি জমি আশঙ্কাজনক হারে কমছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইউএনও সুবীর কুমার দাশ বলেন, মাটি ও পরিবেশের প্রতি অবহেলা, অযথা ভূমি ব্যবহার, এবং নগরায়ণের কারণে আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। আমাদের এই বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে হবে এবং কৃষি সেক্টরে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া, সরকারি উদ্যোগ এবং স্থানীয় জনগণের সহায়তা নিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের সময় কৃষি জমির ক্ষতি না করার বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। এজন্য আমরা নিয়মিতভাবে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সাথে আলোচনা করছি এবং কৃষি জমির সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। 

আরবি/জেডআর

Link copied!