খেজুরের রস ছাড়াই তৈরি হচ্ছে খেজুরের গুড়। দেখতে অরিজিনাল খেজুর গুড়ের মতো মনে হলেও আসলে এসব ভেজাল খেজুর গুড়। এসব গুড়ের উপাদান অপরিশোধিত ভারতীয় চিনি, পুরাতন পঁচা গুড়, রং, আটা, চুন, রাসায়নিক এবং ভেষজ নির্যাস। ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায় প্রতিবছর খেজুর গাছের সংখ্যা কমলেও বাড়ছে ভেজাল গুড়ের উৎপাদন। এজন্য এ উপজেলার ঢেউখালী, নয়রশি ও কৃষ্ণপুরসহ আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে কারখানা। প্রতিদিন এ গুড় যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতে ফরিদপুরের গুড়ের সুনাম নষ্টের পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শীত এলে সদরপুরে এক শ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ী কারিগর এনে অথবা নিজেরাই কারখানা খুলে বসেন। রাতারাতি প্রতিটি কারখানায় ২০০-৩০০ কেজি গুড় তৈরি করেন। এর পর বিভিন্ন হাট বাজারে এসব ভেজাল গুড় বিক্রি করেন। বিশেষ করে চন্দ্রপাড়া ও আটরশি দরবার শরীফের বাৎসরিক ওরস আসলে এসব গুড় বেশি বানান তারা। তখন ভালো দামে বিক্রি করেন এসব গুড়।
সরেজমিন কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, যত্রতত্র গড়ে উঠেছে কারখানা। টিনের তাফালে ভারতীয় অপরিশোধিত চিনি ও গুড়ের টিন কেটে টুকরো করা হচ্ছে। তাফালে দেওয়া হচ্ছে ১০-১২ কেজি ঝোলা গুড়। পরে অপরিশোধিত চিনি ও গুড়ের দলা তাতে মেশানো হচ্ছে। এরপর নির্যাস, রং, রাসায়নিক, চুন ও আটা মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে খেজুরের গুড়। প্রকাশ্যে চলছে এমন কর্মকাণ্ড।
অপরিশোধিত চিনি-গুড় ভারত থেকে আমদানি করা হয় বলে দাবি কারখানা মালিকদের। তাদের ভাষ্য, অনেক আগে থেকেই এসব ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে প্রতি মণ গুড় তৈরিতে খেজুরের রস কিংবা ঝোলা গুড়ের সঙ্গে ৫-১০ কেজি চিনি দেওয়া হতো। এখন টিনভর্তি ভারতীয় অপরিশোধিত চিনি-গুড়ের প্রায় ২২ কেজি উপকরণ মেশানো হয়। এর সঙ্গে ১০-১২ কেজি ঝোলা গুড়, আটা ও রাসায়নিক মেশালেই এক মণ গুড় হয়। প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনি-গুড় ৭০-৮০ টাকায় কিনলেও বাজারের খেজুরের গুড় ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে কয়েক গুণ লাভ হচ্ছে তাদের।
উপজেলার চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়নের এক গাছি আজাদ হোসেন বলেন, আগে ফরিদপুরের নাম শুনলেই ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন গুড় কিনতে। তবে বর্তমানে প্রতারিত হয়ে তারা আগ্রহ হারিয়েছেন। এখন গাছিদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আসল গুড় কিনতে হয়। ভেজাল গুড়ে ভেষজ নির্যাস মেশানোর কারণে আসলের চেয়ে ঘ্রাণ বেশি হয়। বাজারে আসল ও ভেজাল, সব একই দাম। আসল গুড় তৈরি করা কঠিন। এ জন্য রস ও ঝোলা গুড় কেজি হিসেবে স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছি। তারা অগ্রিম টাকা দিয়ে এসব কিনছে।
গুড় তৈরি কারখানার কারিগররা বলছেন, প্রাকৃতিক কারণে খেজুর গাছে আগের মতো রস হয় না। রস ছাড়া আসল খেজুর গুড় তৈরি করবো কিভাবে? গুড়ের পরিমাণ বাড়াতে সামান্য রসের সাথে আমরা চিনি মেশাই। যখন রস থাকেনা তখন পুরাতন গুড়, চিনি আর কেমিক্যাল দিয়ে নতুন গুড় তৈরি করি। তাতে অল্প টাকায় কিছুটা গুড়ের স্বাদ পায় ক্রেতারা। আমরা এসব গুড় তৈরি করছি বলে অনেকে গুড় খেতে পারছে। নাহলে গুড় আর চোখে দেখতে হতো না।
কেমিক্যাল মিশ্রিত গুড় খেলে আলসার, ডায়রিয়া, কলেরাসহ পেটের নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে জানান সদরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর মেডিকেল অফিসার ডা. মো. সালাউদ্দিন। তিনি আরো বলেন, এসব গুড় দিয়ে শিশুদের খাদ্য তৈরি করে খাওয়ালে কিডনি, হৃদযন্ত্র, ব্রেন ও লিভার ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিটুল রায় বলেন, গাছ কমলেও গুড়ের উৎপাদন বেড়েছে। কারখানাগুলোয় নিম্নমানের সাদা ও লাল অপরিশোধিত চিনি-গুড় মেশানো হচ্ছে। এতে গুনগত মান থাকছে না। এতে প্রকৃত উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরা এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করে যাচ্ছি কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ভোক্তা সমিতি (ক্যাব) এর সদরপুর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রভাত কুমার সাহা বলেন, ভেজাল গুড় তৈরি বন্ধে এ উপজেলায় অনেক অভিযান চালানো প্রয়োজন। নতুন কিছু কারখানার তথ্য মিলেছে। সেখানে দ্রুত অভিযান চালানো হবে। এ বিষয়ে শীঘ্রই প্রশাসনের সাথে আমরা আলোচনা করবো।
উপজেলার সচেতন মহল বলছে, কারখানাগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছে না আসল গাছিরা। গাছিরা দৈনিক ১০ কেজি গুড় তৈরিতেই ক্লান্ত আর কারখানা মালিকরা দিনে ১০ থেকে ১২ মণ গুড় তৈরি করছে। বর্তমানে সুনাম হারাতে বসেছে ফরিদপুর অঞ্চলের গুড়। এভাবে চলতে থাকলে সদরপুরসহ ফরিদপুরের গুড় আর চলবে না। সদরপুরে ভেজাল গুড়ের কারখানা বন্ধে দ্রুত অভিযানের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :