কাটাছেঁড়া সব হয়, রোগীকে দেওয়া হয় অ্যানেস্থেসিয়াও। মুমূর্ষু রোগীর জন্য রয়েছে এইচডিইউ, সিসিইউ, এসডিইউ, আইসিইউ। কিডনি রোগীকে দেওয়া হয় ডায়ালাইসিস। জেনারেল বেড, কেবিনসহ দেড় শ শয্যার এই হাসপাতালে চিকিৎসক রয়েছেন অর্ধশত। চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় জটিল সেবা দেওয়া এই হাসপাতালের নিজেরই নেই সরকারি অনুমোদন ও লাইসেন্স অথচ প্রতিদিনই শত শত রোগী আসে চিকিৎসা নিতে, ভর্তি হয় হাসপাতালে। তাদের কাউকে কাউকে নেওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারেও। অবশ করে কাটা হয় শরীরের অঙ্গ, দেওয়া হয় জোড়াতালিও।
ডায়াবেটিক চিকিৎসার পাশাপাশি জটিল চিকিৎসা দেওয়া সেই হাসপাতালের নাম চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল। সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা হতভাগা রোগীরাও জানে না, যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে, সেই হাসপাতাল বহু বছর ধরে সরকারি খাতায় ‘অবৈধ’!
অনুমোদন না থাকলেও নিয়মিত সরকারি অনুদান পায় এই হাসপাতাল। পূর্বে প্রতি বছর ১ কোটি টাকা অনুদান পেলেও ২০১৮ সাল থেকে অনুদান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটিতে। যদিও বছর শেষে এই অর্থের বেশির ভাগই চলে যায় দুর্নীতিবাজ পর্ষদ মেম্বারদের পকেটে। শুধু তাই নয়, ‘চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি’ নামে যে সংগঠন সামাজিক অনুদানের অর্থায়নে পরিচালিত হয়, গত সাত বছর ধরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নথিপত্রে এই সংগঠনও অবৈধ! দীর্ঘ অনুসন্ধান, সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন এই প্রতিবেদক।
তবে তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত এনালগ পদ্ধতির লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। ২০১৭ সালে লাইসেন্স প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড করার পর বেসরকারি সব চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানকে হালনাগাদ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে নতুন করে লাইসেন্স নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রাজনৈতিক দাপট দেখিয়ে সে প্রক্রিয়ায় হালনাগাদ তথ্য জমা দিয়ে নতুন করে লাইসেন্স নেয়নি হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম। রাজনৈতিক ক্ষমতায় সরকারি নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হাসপাতালের সেবা পরিধি বাড়িয়ে নতুন করে যুক্ত করেছেন সার্জারি, কিডনি রোগীর জন্য ডায়ালাইসিসসহ মুমূর্ষু রোগীর আইসিইউ সেবাও।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ডায়াবেটিক রোগীদের সেবা দিতে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের লাইসেন্স নম্বর ৩৬৫৪। তবে কত সালে এই লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই সিভিল সার্জন কার্যালয়ে।
আরও জানা গেছে, ২০১৬ সালে এনালগ পদ্ধতিতে লাইসেন্স প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হালনাগাদ তথ্য সরবরাহ করে ২০১৭ সাল থেকে ডিজিটালাইজড লাইসেন্স পদ্ধতি চালু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সে প্রক্রিয়ায় নতুন করে লাইসেন্স নেয়নি চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল। বছরের পর বছর অবৈধভাবে এই হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো হলেও এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সিভিল সার্জন কার্যালয়। ২০১৭ সালের পর চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল নতুন করে লাইসেন্স নেয়নি বলে এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অফিস সহকারী মো. শাহেদ।
লাইসেন্স না করার কারণে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালকে ‘অবৈধ’ হাসপাতাল বলে উল্লেখ করেন চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে সরজমিনে গিয়ে কথা হয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে। এই হাসপাতালে বেশির ভাগ রোগী ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নিতে এলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী আসে জেনারেল চিকিৎসা নিতে। হাসপাতালে আসা এক রোগীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
হাসপাতালের লাইসেন্স-সংক্রান্ত বিষয়টি জানালে সেই রোগী এই প্রতিবেদককে উল্টো প্রশ্ন করে জানতে চান, ‘অবুক এত্তর হাসপাতাল, লাইসেন্স ছাড়া কেনে চলের (এত বড় হাসপাতাল লাইসেন্স ছাড়া কীভাবে চলে)? অন্যদিকে যে ‘সমিতি’র ব্যানারে পরিচালিত হচ্ছে এই হাসপাতাল, ২০১৮ সালের পর সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে সেই সংগঠনের কোনো অনুমোদন নেয়নি পরিচালনা পর্ষদ। এ কারণে ২০১৮ সালের পর থেকে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির কর্মকাণ্ড পুরোপুরি অবৈধ বলে জানান চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফরিদুল আলম।
তিনি জানান, ১৯৭৮ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে নিবন্ধন নেয় ‘চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি’, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর সি-৬৯৫/৭৮। গত বছরের ২৫ জানুয়ারি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অফিস আদেশ স্মারক নম্বর৪১.০১.০০০০.০৪৬.২৭.০২৫.২২.১০০ মূলে সংস্থার তৎকালীন কমিটিকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (রেজিস্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর বিধান মোতাবেক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। কাজেই সংস্থার অনুমোদিত কার্যকরী কমিটির সাধারণ সভা আহ্বান ও নির্বাচন আয়োজনের বৈধতা নেই।
তিনি আরও জানান, সংস্থার কার্যক্রম বিষয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নম্বর ১৬১০/২০২৩ চলমান আছে। যে কারণে আদালতের চূড়ান্ত রায় না পাওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির নির্বাচনসংক্রান্ত কার্যক্রম করার সুযোগ নেই।
তবে তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারের অনুমোদন না থাকলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রতি বছর ২ কোটি টাকা অনুদান পায় এই হাসপাতাল। কিন্তু অনুদানের সেই অর্থ হাসপাতালের রোগীদের জন্য ব্যয় না করে অর্থ চলে যায় ব্যক্তিগত তহবিলে। সরকারি অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি ইতিমধ্যে প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) উম্মে হাবিবা গত ৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের বরাবর আত্মসাৎকৃত সরকারি টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য একটি পত্র পাঠান, যার স্মারক নং ৪৫.০০.০০০০.৭২.২৭.০০১.২১-৯৭। ওই পত্রে তিনি উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে সরকারি তহবিল তছরুপসহ স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং সরকারি অনুদানের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ‘সতের লক্ষ পঞ্চাশ হাজার’ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ‘দশ লক্ষ’ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ রয়েছে মর্মে মতামত প্রদান করা হয়।
আত্মসাৎকৃত অর্থ ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা প্রদানের আদেশ দেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরত দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
যদিও চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের সাবেক সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর মুঠোফোনে বলেন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালাতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না।
হাসপাতাল পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্স আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আছে। লাইসেন্স ছাড়া হাসপাতাল চালানো যায় নাকি?’ এ বিষয়ে কথা বলার জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. অং সুই প্রু মারমাকে মুঠোফোনে কল দেওয়া হলেও কল রিসিভ করেননি তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :