ঢাকা সোমবার, ০৬ জানুয়ারি, ২০২৫

সিএনজি স্টেশনে চাঁদাবাজি

সালমান ফরিদ, সিলেট

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২৪, ০৬:০৯ এএম

সিএনজি স্টেশনে চাঁদাবাজি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সিলেটের শহর এলাকার প্রতিটি সিএনজি স্টেশনে রয়েছে শিল্প এলাকার স্থাপন লাইসেন্স। সেই লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী যত শব্দমাত্রা হওয়ার কথা, তার চেয়ে কম মাত্রার শব্দ উৎপন্ন হয়। তবু একে ‘শব্দদূষণ’ ধরে  বিভিন্ন স্টেশনের বিরুদ্ধে জরিমানা, মামলা ঠুকে দিচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এমনকি ফোন করে অভিযানের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজিও করা হচ্ছে। এমন অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনর্ভাসন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।

তারা বলছে, সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক বিশেষ সুবিধা পেতে ব্যর্থ হয়ে মামলা ও জরিমানার খড়্গ চাপিয়ে দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। অ্যাসোসিয়েশন সিলেট বিভাগীয় সভাপতি ও সিলেট চেম্বারের সাবেক পরিচালক আমিরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরের সব শর্ত মেনেই স্টেশন স্থাপন করেছি। কিন্তু এই পরিচালক এসেই যে তৎপরতা শুরু করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে সিলেটের প্রতিটি স্টেশন অনিয়মের মধ্যে ডুবে আছে। তিনি যে হারে জরিমানার ভয় দেখান, তা দিতে হলে মালিকদের রীতিমতো পথে বসতে হবে।’

তবে তাদের এই দাবি অস্বীকার করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার। তিনি বলেন, ‘আমি যা করছি তা আইন অনুযায়ী করছি। নিয়ম হচ্ছে বছরে দুবার পরিদর্শনের। এই পরিদর্শনে গেলে তারা বাধা দিচ্ছেন। এমনকি আর্থিক সুবিধা দিয়ে পরিদর্শন থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেন। আমরা তাদের প্রস্তাবে রাজি হই না বা সুবিধা দিই না বলেই হয়তো আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন তারা।’

তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজির অভিযোগও সঠিক নয়। এটি অনলাইন অপরাধ। যে চক্র সারা দেশে অনলাইনে চাঁদাবাজি করছে, হয়তো তাদের কাজ। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কেউ তাতে জড়িত নয়। প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, শিল্প এলাকায় শব্দদূষণের নির্দিষ্ট মাত্রা দিনের বেলায় ৭৫ ডেসিবেল এবং রাতের বেলায় ৭০ ডেসিবেল। বাণিজ্যিক এলাকায় শব্দদূষণের নির্দিষ্ট মাত্রা দিনের বেলায় ৭০ এবং রাতের বেলা ৬০ ডেসিবেল। শহরের বাইরেও আবাসিক এলাকায় দিনের বেলায় ৫৫ এবং রাতের বেলায় ৪৫ ডেসিবেল। কিন্তু শহরে কোনো স্টেশনই শব্দদূষণ করছে না। স্টেশন বন্ধ থাকা অবস্থায় পাশের রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী যানবাহন থেকে যে দূষণ হয়, তা এর চেয়ে বেশি। সুতরাং একে শব্দদূষণ বলা যায় না। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর তাকে শব্দদূষণ ধরে প্রতিটি সিএনজি স্টেশনকে চিঠি দিচ্ছে। অফিসে গিয়ে জরিমানা আদায় করতে বলা হচ্ছে। কয়েক দিন আগে কুলাউড়া উপজেলার বাসস্ট্যান্ডের পাশে মেসার্স গর্নভেলি সিএনজি স্টেশনে অধিদপ্তরের কর্তারা গিয়ে ১৬ লাখ টাকা জরিমানা করেন। পরে অফিসে এসে মালিকপক্ষ দেনদরবার করে সেই জরিমানার পরিমাণ ১ লাখ ৩২ হাজার টাকায় নামিয়ে আনে। গত সপ্তাহে সিলেট নগরীর সুরমা সিএনজি স্টেশনে গিয়েও ১৬ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ এত পরিমাণে জরিমানা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর হস্তক্ষেপে সুরমা সিএনজি স্টেশনকে ৪ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে রক্ষা পেতে হয়। 

সূত্র জানায়, ১৯৯৮-৯৯ সালে দেশে প্রথম সিএনজি স্টেশন স্থাপনের সময়ই ২৫ কোটি ডলার আন্তজার্তিক সহায়তায় শব্দদূষণ রোধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেয় সরকার। সেই থেকে মাত্রা নিশ্চিত করার শর্তেই স্টেশনগুলোকে ছাড়পত্র দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়। এযাবৎকালে কখনোই শব্দদূষণের অভিযোগ ওঠেনি স্টেশনগুলোর ওপর। যদিও ২০১৮ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর সামগ্রিকভাবে দেশে সিএনজি স্টেশনের আশপাশে শব্দদূষণ হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলে। তবে সব জায়গায় এই অভিযোগ সঠিক ছিল না বলে তা আর এগোয়নি। কিন্তু বর্তমান পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক সিলেটে যোগদানের পর শব্দদূষণ রোধ ও পরিবেশ সুরক্ষায় মাঠে নামেন। তিনি স্টেশনগুলো পরিদর্শন করে প্রতিটিকে অভিযুক্ত করেন। কয়েকটির বিরুদ্ধে চিঠি ইস্যু করেন এবং জরিমানাও করেন। 

অ্যাসোসিয়েশন জানায়, সিলেটে মোট ৫৩ সিএনজি স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট নগরীতে সবচেয়ে বেশি, ৩২টি। বাকিগুলোর মধ্যে মৌলভীবাজারে ১১, সুনামগঞ্জে ৪ এবং হবিগঞ্জে ৬টি। এগুলোর মধ্যে ১০টিরও বেশি স্টেশনে মোবাইল ফোনে ‘শব্দদূষণ হচ্ছে’ এমন অভিযোগ এনে কল করে চাঁদা দাবি করা হয়। প্রথমে বলা হয়, স্টেশনে শব্দদূষণ হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেট অভিযানে যাবেন। তবে গাড়িভাড়া, চা-নাশতার খরচাপাতি দিলে মোবাইলকোর্ট অভিযানে যাবে না। এ জন্য নম্বর দিয়ে মোবাইল লেনদেনকারী ‘নগদ’-এ ১০ হাজার টাকা পাঠাতে বলা হয়। 

অ্যাসোসিয়েশন সিলেট বিভাগীয় সভাপতি ও সিলেট চেম্বারের সাবেক পরিচালক আমিরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘চার দিন আগে এরকম একটি ফোন আমার কাছেও এসেছিল।

পরিবেশ অধিদপ্তর শব্দদূষণ নিয়ে আমাদের যখন জরিমানা করছে, মামলা দিচ্ছে, তখনই এমন ফোন আমাদের নানা রকম সন্দেহে ফেলে দিচ্ছে। ঠিক এই সময়ে কেন ফোন আসবে, আগে এলো না কেন?’ তিনি বলেন, ‘আমাদের অন্তত পাঁচজন এমন ফোনকল পেয়েছেন। তবে কেউই টাকা নগদে পাঠাননি। বিষয়টি নিয়ে আমাদের প্রত্যেক সদস্যকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে সিএনজি স্টেশন মালিকদের মধ্যে।

এদিকে গতকাল শনিবার দুপুরে সিলেট নগরীর উপশহরের কার্যালয়ে বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সিলেট বিভাগ এসব নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসে। সেখানেও জরিমানা, মামলা ও চাঁদাবাজির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। অ্যাসোসিয়েশন সিলেটের বিভাগীয় সভাপতি ও সিলেট চেম্বারের সাবেক পরিচালক আমিরুজ্জামান চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানের পরিচালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কামাল উদ্দিন, সহসাধারণ সম্পাদক সাজুওয়ান আহমদ, সাংগঠিনক সম্পাদক আলী আফছার মো. ফাহিম, অর্থ সম্পাদক ফয়েজ উদ্দিন আহমদ, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুব্রত ধর বাপ্পি, সিনিয়র সদস্য প্রফেসর সিরাজুল হক, ইফতেখার আহমেদ, সারজন রাসু, মো. নাফিস জুবায়ের চৌধুরী, আনহার উদ্দিন, আকবর হোসেন আলি, সাব্বির আহমদ, আখতারুল ইসলাম, লোকমান আহমদ মাছুম, সাইমুল আলম সেতু, আব্দুস সহিদ মিয়া, হারুনুর রশিদসহ অনেকে।

আরবি/জেডআর

Link copied!