খুলনার কয়রা উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র গরুর খামারীদের খাদ্যের পাশাপাশি নগদ ১০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে তালিকায় যুক্ত হয়ে শুধু গো-খাদ্য পাওয়ায় নানা গুঞ্জন দেখা দিয়েছে। এছাড়া গরু না থাকার পরেও ভুয়া তথ্যের মাধ্যমে প্রতিটি এলাকার একাধিক ব্যক্তি গো-খাদ্য পেয়েছে। তথ্য সংগ্রহকারীদের দায়িত্বহীনতায় এসব ভুয়া ব্যক্তি মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। আর একই এলাকার প্রকৃত গরু পালনকারীরা হয়েছেন বঞ্চিত।
জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন অব দ্যা ইউনাইটেড ন্যাশন (এফএও) এর অর্থায়নে সেবা মানব কল্যাণ কেন্দ্র (এসএমকেকে) নামক একটি এনজিও বাস্তবায়ন করেন। তারা কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ও উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের মোট এক হাজার ৮০০ পরিবারকে গো-খাদ্য সহায়তা করেছেন।
কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের জয়পুর, শিমলার আইট, শ্রীরামপুর, দেয়াড়া গ্রামে সরেজমিন পরিদর্শন করে জানা যায়, বাড়িতে গরু নেই এমন একাধিক পরিবার গো-খাদ্য পেয়েছেন। গরুর কথা জানতে চাইলে তারা নয়ছয় বুঝিয়েছেন। একই বাড়ির একাধিক ব্যক্তি এবং অধিক স্বচ্ছলরা সহায়তা পেলেও পাশ্ববর্তী গরু রয়েছে এমন দারিদ্র পরিবার বাদ পড়েছে। তথ্য সংগ্রহকারী কর্মীরা বাড়ি বাড়ি না যেয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রধান্য দিয়ে তাদের কথা অনুযায়ি একস্থানে জড়ো করে অনেকের তথ্য নিয়েছেন। বাড়িতে গরু আসে কিনা সেটা না দেখেই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করে অনলাইনে তথ্য আপলোড করেন। বাড়িতে প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী, দুগ্ধদানকরীসহ রিমালে অধিক ক্ষতিগ্রস্থদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা যাচাই করেন নি। আর এই সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ১০ হাজার টাকা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা অর্থবাণিজ্য করেছেন বলে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জয়পুর গ্রামের কামরুল গাজী, আব্দুল হামিদ খোকন মোড়ল, আবু সাঈদ খাঁ, আব্দুল গফুর মোড়লসহ ১০ জন উপকারভোগীর বাড়ি যেয়ে মাত্র ২ জনের বাড়ি গরুর দেখা মেলে। এছাড়া একই গ্রামের একটি পাকা বাড়িতে কয়েকটি গরু রয়েছে এবং ওই বাড়ির দুই ছেলে ও পিতা খাবার পেয়েছেন বলে জানা যায়।
ওই গ্রামের লিয়াকত, আমেনা, বিল্লাহসহ কয়েকজন ব্যক্তি জানান, তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি যেয়ে তথ্য যাচাই করেন নি। গো-খাদ্য ও সহায়তা হিসেবে ১০ হাজার টাকা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে স্থানীয় এক প্রভাবশালী দুই হাজার টাকা দাবি করেন। যারা টাকা দিয়েছেন কিংবা তার ঘণিষ্ঠ তারা গো-খাদ্য পেয়েছেন।
একই গ্রামের এক ভ্যান চালকের স্ত্রী ফাতেমা বলেন, আমাদের গরু রয়েছে। আমরা গরিব মানুষ, বসতবাড়ি ছাড়া কিচ্ছু নেই। আমাদের পাশে অনেকেই পেয়েছেন যাদের গরু নেই। তবে আমরা পাইনি। তিনি আরও জানান, বিতরণের খবর পেয়ে পরিষদে গিয়ে স্টেজে উপস্থিতদের সামনে অভিযোগ দিলেও উল্টে অবাঞ্চিত প্রশ্ন করে লাঞ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। একই এলাকার ইউসুফ, লিয়াকত, অজিয়ার জানান, গরু থাকতেও তারা বঞ্চিত হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জয়পুর গ্রামের খাদ্য সহায়তা পাওয়া এক মহিলা জানান, তার কাছে দুই হাজার টাকা চাওয়া হয়, তিনি দেড় হাজার টাকা দেন। তিনি এক বস্তা খাদ্য ও একটা সাইলো (খাবার রাখার পাত্র) পেলেও কোন টাকা পাননি। তার বাড়িতে কোন গরুর দেখা মেলিনি। তিনি জানান, গরু তার আত্নীয়ের বাড়িতে রয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকজন সুফলভোগীর সাথে কথা বলে টাকা দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
শ্রীরামপুর গ্রামের শিমুল, জবারুল, সিরাজুল, আঃ মাজেদ সরদারসহ বেশ কয়েকজনের বাড়িতে গরুর দেখা মেলেনি। শিমুল সরদার নামের এক উপকারভোগী জানান, তার ও জবারুলের গরু নেই। তবে শ্রীরামপুর গ্রামের কার্ডগুলো তাদের কাছে দেয়া হয়। তারা শুধুমাত্র কার্ডগুলো সুফলভোগীদের কাছে পৌছে দিয়েছেন। কোন অর্থ লেনদেন হয়নি বলে তিনি দাবি করেন। আর কার্ড পৌছে দেওয়ার কাজ করায় চেয়ারম্যান তাদেরকে দিয়েছেন।
দেয়াড়া ও শিমলার আইট গ্রামেও একই চিত্র দেখা যায়। দেয়াড়া গ্রামের নূন্যতম ২০ জনের বাড়ি গরু নেই বলে জানা যায়। এছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি গ্রামের স্থানীয় প্রভাবশালীদের সুপারিশ অনুযায়ি তথ্য অনলাইনে আপলোড করা হয়। সত্যতা নিশ্চিতের জন্য তথ্য সংগ্রহকারীদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কথা থাকলেও সেটা পালন করেন নি তারা। ফলে মিথ্যা তথ্য ইনপুট হওয়ায় একদিকে ভুয়া নাম তালিকায় যুক্ত হয়েছে অন্যদিকে প্রকৃতরা বঞ্চিত হয়েছেন।
সেবা মানব কল্যাণ কেন্দ্র নামক একটি এনজিও কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। ওই এনজিও কয়রা উপজেলা পরিষদে কয়েকদিন পূর্বে একটি অবহিত সভার আয়োজন করেন। ওই সভায় প্রকৃত ব্যক্তিদের প্রাপ্তি নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিতরণের কয়েকদিন পূর্বে উন্মুক্তস্থানে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের দাবি তোলেন উপস্থিতরা। তালিকা প্রকাশের পরে গরু নেই এমন কারো বিপক্ষে অভিযোগ আসলে যাচাই করে তাকে বাদ দেওয়া ও অপেক্ষাকৃতদের তালিকা থেকে যুক্ত করার সুপারিশ করেন তারা। তবে সভায় প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটা বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে জানা যায়। এছাড়া বিতরণ সম্পন্নের পরেও সেবা মানব কল্যাণ কেন্দ্র ও ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) এর একাধিক কর্মী-কর্মকর্তাদের কাছে তালিকা চেয়েও পাওয়া যায়নি। সেবা মানব কল্যাণ কেন্দ্রের ওয়েব সাইটের নম্বরে যোগাযোগ করেও মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন অব দ্যা ইউনাইটেড ন্যাশন এর ঢাকা অফিসের জুনিয়র প্রোগ্রাম স্পেশালিষ্ট সালাউদ্দিন বলেন, গরু রয়েছে এমন পরিবারের তালিকা আমরা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে নিয়েছি। আর পরিবারের আয়-ব্যয়-ক্ষতিগ্রস্থসহ সার্বিক বিষয়ে খোঁজ খবর আমাদের কর্মীরা নিয়েছেন। যে পরিবার রিমালে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যে পরিবারে প্রতিবন্ধী, গর্ভবর্তী, মাতৃদুগ্ধদানকারী ও শিশু রয়েছে, সে পরিবারকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। গরু নেই এমন পরিবার পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। অনিয়মের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
তিনি আরও জানান, আমরা খাদ্য রাখার জন্য একটি সাইলো ও ২৫ কেজি গো-খাদ্য দেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পে কোন টাকা দেওয়ার কথা ছিল না।
কয়রা উপজেলা প্রাণি সম্পদ দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলইও কর্মকর্তা ডা. হাসান ফেরদাউস বলেন, আমাদের অফিস থেকে গরু রয়েছে এমন পরিবারের কোন তালিকা দেয়া হয়নি। তারা নিজেরা যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রনয়ন করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :