বাজারে খাওয়ার আলুর অতিরিক্ত দামের কারণে ঠাকুরগাঁওয়ে ব্যাপক সংখ্যক কৃষক আলু চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। বিগত বছরে যেসব জমিতে গম, মরিচ, সরিষা ও ভুট্রা চাষ হতো সেসব জমিতে এবার লাগানো হচ্ছে আলু। এছাড়াও গত বছর একজন কৃষক ৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন, সেই কৃষকই এবার ১০ বিঘা জমিতে বা তারও বেশি জমিতে আলুর চাষ করছেন। দিগন্ত জুড়ে চাষ হচ্ছে আলু আর আলু। ধারণা করা হচ্ছে, আসন্ন আলু মওসুমে আলুর বাম্পার ফলন হলে আলু সংরক্ষণের মতো জায়গা পাওয়া নিয়ে বিপাকে পড়বেন চাষীরা।
জানা গেছে, চলতি বছর ২৭ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে জেলা কুষি সম্প্রসারণ বিভাগ। কিন্তু ইতোমধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে প্রায় দ্বিগুন জমিতে আলু রোপন করা হয়েছে। কৃষি বিভাগের মতে, এই সংখ্যা ৩২ হাজার ৬৮০ হেক্টর। তবে রোপনকৃত জমির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি বিভাগ। আর লক্ষ্যমাত্রাকৃত জমিতে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ লক্ষ ৮৭ হাজার ৫শ মেট্রিক টন।
ঠাকুরগাঁও জেলার ৫ উপজেলায় প্রতি বছর আমন ধান তোলার পর গম, আলু, ভুট্টা ও মরিচ সহ বিভিন্ন ফসল চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়েন চাষীরা। সদর উপজেলা ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় গম, সদর উপজেলায় মরিচ এবং সদর ও হরিপুর উপজেলায় এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ভুট্রার আবাদ হয় সবচেয়ে বেশি। গম ও ভুট্রার ক্ষেতে পানি সেচ কম লাগায় কৃষকেরা এই দুটি ফসল চাষে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে বেশি। তবে মরিচের দাম বেশি পাওয়ায় কয়েক বছর যাবত বেশিরভাগ কৃষক মরিচ চাষাবাদে জড়িয়ে পড়ে।
চলতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেও বাজারে আলুর কেজি ৭০-৭৫ টাকা থাকায় কৃষকরা বেশি লাভের আশায় আলুর আবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। এ কারণে এ বছর মরিচ,গম ও ভুট্রা আবাদ হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন চাষীরা ।এ সুযোগে বাজারে বীজের আলু ও রাসায়নিক সারের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে।৯০ থেকে ১শ টাকা বা তারও বেশি টাকা কেজি দরে আলু বীজ কিনে ক্ষেতে রোপন করছেন চাষীরা। একই কারণে সারের চাহিদাও বেড়েছে আশংকাজনক হারে। আর চাহিদা বেশি দেখা দেওয়ায় এক শ্রেনীর মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সারের কৃত্রিম সংকট তৈরী করে বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য করছেন চাষীদের।
বেশিরভাগ কৃষকের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত দামে রাসায়নিক সার পাওয়া যাচ্ছে না।এ সুযোগে এক শ্রেনীর পাইকার ১৩শ ৫০ টাকা দামের টিএসপি সার ১৮শ থেকে ১৮৫০/- টাকা এবং এমওপি সার এক হাজার ৫০ টাকার স্থলে ১২শ ৫০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
এ ব্যপারে ভুক্তভোগী কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন,ডিলার ও খুচরা দোকানে কোথাও চাহিদা অনুযায়ী সার পাওয়া যাচ্ছেনা। ডিলাররা রাতের আঁঘনিমহেশপুর গ্রামের ধারে পাইকারদের নিকট বেশি দামে বিক্রি করে দেওয়ায় এবং ছোট পাইকাররা কম দামে বিক্রি না করায় এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
ঘনিমহেশপুর গ্রামের ইব্রাহিম আলী নামে একজন আলু চাষী বলেন, এবার আমি ৩০বিঘা জমিতে আলূ রোপন করেছি।এজন্য অনেক সার দরকার।কারণ সঠিক সময়ে ক্ষেতে সার দিতে না পারলে কাঙ্খিত উৎপাদন পাওয়া যাবে না।তাই দাম বেশি হলেও সার সংগ্রহ করতে হচ্ছে। ছোট পাইকারদের দামে বেশি দিলে সার পাওয়া যায় ।কিন্তু বড় ডিলাররা সার নেই বলে জানিয়ে দিচ্ছেন।
তরিকুল ইসলাম নামে একজন সার বিক্রেতা বলেন, আমরা ডিলারদের কাছে ১২শ টাকার সার ১৭শ টাকায় কিনে এনে ১শ টাকা লাভে বিক্রি করছি।তাই কিছু কৃষক সার পাচ্ছে।নইলে সারের জন্য হাহাকার শুরু হতো।
এ ব্যপারে কয়েকজন ডিলার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সরকার নির্ধারিত দামেই সার বিক্রি করা হচ্ছে। তবে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে।
দেবিপুর এলাকার আলু চাষি নূর ইসলাম বলেন, এ বছর ব্যাপক জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। যে পরিমাণ আলূর আবাদ হয়েছে তাতে উৎপাদন মওসুমে আলু নিয়ে কৃষককে পথে বসার উপক্রম হতে পারে।কারণ ঠাকুরগাঁও জেলায় যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয় তার তুলনায় কোল্ড স্টোরেজ কম।সংখ্যায় ১৭টি।আমরা কয়েক বছর ধরে প্রতি বস্তা আলুর ভাড়া কমানোর দাবি জানালেও তা মানছে না কোল্ড স্টোরেজ মালিক সমিতি।দেশের বিভিন্ন জেলায় কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া কম ,শুধু ঠাকুরগাঁও জেলায় ভাড়া বেশি।
জেলা কুষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর চলমান রবি মওসুমে চাষাবাদ বেশি হয় এবং সার সংকট যেন না হয় সে কারণে এবার ডিলারদের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দিয়েছি।শুনছি বাফার গুদামে অতিরিক্ত ভীড়।সে কারণে বাজারে সারের সংকট খানিকটা দেখা দিয়েছে।তবে বরাদ্দকৃত সার আনতে পারলে সারের সংকট কেটে যাবে ।আশা করছি এক সপ্তাহের মধ্যে মধ্যে সারের সংকট দূরিভূত হবে।
এ ব্যপারে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইসরাত ফারজানা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এবার ঠাকুরগাঁওয়ের চাষীরা গম ও ভুট্রার চাষের চাইতে আলু আবাদে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সে কারণে এখানে সারের চাহিদাও বেড়ে গেছে।এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সার এবং বীজ আপাতত: সংকট নেই। বাজারে পর্যাপ্ত সারও রয়েছে। তবে কোথাও কোথাও বেশি দামে সার সংগ্রহ করার অভিযোগ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটগণ তদারকি করছেন। কোথাও কোন অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে আমরা সাথে সাথে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি। সার ও বীজ নিয়ে কেউ যেন কোন প্রকার সমস্যা তৈরী করতে না পারে সে বিষয়ে কিৃষি বিভাগসহ আমরা তৎপর রয়েছি।
আপনার মতামত লিখুন :