নানা অভিযোগে বাংলাদেশে ইসকনের এক ধর্মগুরুকে গ্রেপ্তারের পর ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার হিন্দুধর্মাবলম্বী বাসিন্দারা মিছিল-মিটিং করছেন। তারা বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ঢোকারও চেষ্টা করছেন। সে দেশের পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষা বাহিনী তাদের আটকে দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে সাম্প্রতিক উত্তেজনার কারণে সিলেট সীমান্ত দিয়ে দুদেশে যাতায়াতকারী যাত্রীর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। জকিগঞ্জ ও শেওলা বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশি সব পণ্য ভারতে প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছেন সে দেশের উত্তেজিত বিক্ষোভকারী হিন্দুধর্মাবলম্বীরা। তামাবিল সীমান্ত দিয়েও পণ্য আসছে না, যাচ্ছেও না। শুল্ক বন্দরের কার্যক্রম এখন বন্ধ। দুপারে আটকে আছে শত শত পণ্যবাহী ট্রাক।
এ ছাড়া বন্দরগুলো দিয়ে ভিসাধারী বাংলাদেশিদেরও প্রবেশে বাধা দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশি পর্যটক ও যাত্রীরা ভারতে প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। মঙ্গলবার জকিগঞ্জ সীমান্ত ছিল অনেকটা নিষ্প্রাণ। তামাবিলে যাতায়াত করেছেন হাতেগোনা কয়জন মাত্র। যা অন্য স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক কম। এদিকে পরিস্থিতিও খুব একটা স্বাভাবিক না থাকায় সিলেটের ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ভারতে তাদের নিয়মিত সব ট্রাভেল প্যাকেজ বাতিল করেছে। অপরদিকে বাংলাদেশি সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিজিবি সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করেছে। রয়েছে সতর্ক অবস্থায়। অতিরিক্ত ফোর্স নিয়োগ করে টহলও বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে সীমান্ত এলাকায় এখন গুমোট হাওয়া বিরাজ করছে। বেড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও।
একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর সিলেট সীমান্তের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে জকিগঞ্জ এবং শেওলা সীমান্তে। এ দুটি স্টেশন দিয়ে পণ্য আমদানির চেয়ে রপ্তানি হয় বেশি। অপরদিকে তামাবিল বন্দর দিয়ে আমদানির হার বেশি।
ভারতের করিমগঞ্জের গণমাধ্যমগুলো জানায়, সোমবার দুপুরের দিকে করিমগঞ্জের (সাম্প্রতিক পরিবর্তন করা নাম- শ্রীভূমি) স্থানীয় বিধায়কের নেতৃত্বে সনাতনি ঐক্য মঞ্চ সংগঠনের সদস্যরা বাংলাদেশি সব পণ্যের প্রবেশ ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে দেন। তারা সীমান্তে বাংলাদেশি পণ্যে আগুন ধরিয়ে দিয়ে রপ্তানির চেষ্টা না করতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সাবধান করে দেন। সেই থেকে জকিগঞ্জ সীমান্ত বন্দর দিয়ে সব ধরনের পণ্য রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।
রোববার ও সোমবার ভারতের সীমান্তবর্তী আগরতলা, করিমগঞ্জ ও সুতারকান্দি এলাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ করে স্থানীয় উগ্র হিন্দত্ববাদী গোষ্ঠী। আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার সনাতনি ঐক্য মঞ্চ নামের একটি সংগঠনের বিক্ষোভের মুখে সোমবার বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, সোমবার দুপুরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধের আগে জকিগঞ্জ শুল্ক বন্দর দিয়ে ভারতের করিমগঞ্জ থেকে প্রায় ছয় টন কমলা বাংলাদেশে আমদানি হয়। এই চালানের পর আর কোনো পণ্যের চালান ভারতে যায়নি, বাংলাদেশেও ঢোকেনি।
আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জকিগঞ্জ শুল্ক বন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ভারতের করিমগঞ্জ শুল্ক বন্দরে সেখানকার বিক্ষোভকারীরা বিক্ষোভ করে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের এলসি করা মালামালের গাড়ি ফেরত দিয়েছেন। তিনি জানান, জকিগঞ্জ শুল্ক বন্দর দিয়ে ভারতে কোনো পণ্য দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানি হয় না। তবে ফলমূলসহ কিছু পণ্য আমদানি হয়। আর শেওলা (ভারতের সুতারকান্দি) স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি প্রাণ, আকিজসহ কয়েকটি কোম্পানির পণ্য ভারতে রপ্তানি হয়।
ভারতের করিমগঞ্জের একাধিক সূত্র জানায়, গত সোমবার ও মঙ্গলবার রপ্তানি হওয়া পটেটো, কেকসহ কিছু পণ্য সনাতনি ঐক্যমঞ্চের সদস্যরা পুড়িয়ে ফেলেন। তারা বাংলাদেশি পণ্য বয়কটের ঘোষণাও দিয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য ভারতের উত্তর আসামের এমএলএ কমলাখ্যা দে পুরকায়স্থ করিমগঞ্জ (শ্রীভূমি) জেলা প্রশাসককে একটি চিঠিও দিয়েছেন। তাতে তিনি বলেন, বাংলাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সুতারকান্দি সীমান্ত এবং করিমগঞ্জের স্টিমারঘাট হয়ে নদীপথে বাংলাদেশের সাথে রপ্তানি ও আমদানি বন্ধ করার অনুরোধ করছি।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও পাথর আমদানিকারক গ্রুপ সূত্র জানায়, সোমবার পর্যন্ত ভারতের সুতারকান্দিতে পাথরসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী অন্তত ২০০ ট্রাক এবং এপারে শেওলা শুল্ক বন্দরে অর্ধশতাধিক ট্রাক আটকা পড়েছে। এ ছাড়া সিলেটের জকিগঞ্জের ওপারে ভারতের করিমগঞ্জে আটকা পড়েছে ফল ও কাঁচামালবোঝাই অর্ধশতাধিক ট্রাক।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক পরিচালক এবং পাথর আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি আতিক হোসেন জানান, বর্ডারে পণ্য আটকা পড়ায় ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রতিদিনই আমদানিকারকদের ব্যাংকঋণের সুদ গুনতে হচ্ছে। এ ছাড়া পাথর ও চুনাপাথর আমদানি বন্ধ থাকায় লোড-আনালোড এবং স্থানীয় পাথরভাঙার কলগুলোর হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
এদিকে ভারতীয়দের বিক্ষোভে গত বুধবার মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার চাতলাপুর শুল্ক বন্দর দিয়েও ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানিসহ সব বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তামাবিল সীমান্ত দিয়েও কোনো পণ্য আসা-যাওয়া করছে না। বিক্ষোভে সিলেট সীমান্তের স্থলবন্দরগুলো দিয়ে যাত্রীদের আসা-যাওয়াও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ৫ আগস্টের পর ভিসা কমিয়ে দেওয়ায় এমনিতেই যাত্রীদের আসা-যাওয়া আগের তুলনায় কম। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে উভয় দেশের মানুষের মধ্যে চলমান ক্ষোভ তাতে আরও বেশি প্রভাব ফেলে। সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি পর্যটক ও যাত্রীরা ভারতে যাতায়াত করতেন। আগে প্রতিদিন গড়ে ৭০০ যাত্রী যাতায়াত করলেও এখন সেই সংখ্যা ১০০ জনেরও কম। সোমবার মাত্র ৭০ জন যাত্রী ও পর্যটক এই স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতে যাতায়াত করেছেন বলে জানিয়েছে তামাবিল বন্দর ইমিগ্রেশন। মঙ্গলবার সেই সংখ্যা আরও কম বলে জানায় তারা। ইমিগ্রেশন অফিসার আবদুর রাজ্জাক দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, খাসিয়া এলাকা হওয়ায় এদিকে তেমন একটা প্রভাব নেই চলমান ক্ষোভের। তবে যাত্রী যাতায়াত কমে গেছে।
সিলেটের ট্রাভেল এজেন্টরা জানান, ঠিক এই মুহূর্তে ভারতে বাংলাদেশিদের অন্য চোখে দেখা হচ্ছে। নিরাপত্তার অভাবও রয়েছে। সে জন্য এজেন্টগুলো তাদের ভারতে সব ট্রাভেল প্ল্যান ও প্যাকেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে।
ট্রাভেল এজেন্ট হুমায়ুন কবির লিটন জানান, এ মুহূর্তে ভারত আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। আমরা সবচেয়ে বেশি ট্যুর করে থাকি ভারতের মেঘালয়ে। যদিও এ অঞ্চলে বাংলাদেশবিদ্বেষ খুব একটা নেই, আদিবাসী এলাকা। তবুও নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা ভারতে গ্রুপ পরিচালনা বন্ধ রেখেছি।
এদিকে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভারতের মিডিয়াগুলো অনুপ্রবেশের অভিযোগ তুললেও সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিদের কোনো অনুপ্রবেশ ঘটছে না। এটি মিথ্যা প্রপাগান্ডা।
আপনার মতামত লিখুন :