ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারি, ২০২৫

বেদখল ভূমি নিয়ে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের লুকোচুরি!

জালালউদ্দিন সাগর, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪, ০৫:১২ পিএম

বেদখল ভূমি নিয়ে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের লুকোচুরি!

ছবি, রূপালী বাংলাদেশ

দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ রেলওয়ের বেদখল হওয়া ভূমি উদ্ধারে জোর তৎপরতা দেখা গেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে। যেসব জমি দখল করে স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, তা ৫ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত তারিখ পেরিয়ে গেছে সেই কবে; কিন্তু এখনো জমি উদ্ধারে কোনো ক্রাশ প্রোগ্রাম নিতে দেখা যায়নি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভূমি বিভাগের কর্মকর্তাদের। পূর্বাঞ্চলের ভূমি বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথোপকথনে জানা যায়নি কোনো পরিকল্পনার কথাও। শুধু তাই নয়, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে কী পরিমাণ ভূমি আছে, তার মধ্যে কতখানি দখল আর কতখানি বেদখল, সেই তথ্য সাংবাদিকদের দিতে নারাজ কর্মকর্তারা। লুকোচুরি করছেন ভূমি সম্পত্তির তথ্য নিয়ে। তবে রেলের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রেলের বেদখলকৃত জমি উদ্ধারের এটাই মোক্ষম সময়। যেহেতু বর্তমান সময়টা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, সেহেতু এই সময়ে বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করা অনেকটাই সহজ হবে।

তবে অভিযোগ রয়েছে, প্রতি মাসে লোকদেখানো দুই-একটা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা ছাড়া বেদখল হয়ে যাওয়া শত শত একর ভূমি উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। যে কারণে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরও বেদখল হওয়া ভূমি উদ্ধারে নিষ্ক্রিয়তার প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ মানুষ।  

অনেকের অভিযোগ, বেদখল হওয়া ভূমি উদ্ধারে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিতার পেছনে রয়েছে দুর্নীতি। দখলবাজদের কাছ থেকে মাসিক কিংবা বাৎসরিক উৎকোচ গ্রহণ করতেই হাতছাড়া হচ্ছে হাজার কোটি টাকা ভূমি সম্পত্তি।

গত রোববার চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের পাশে বছরের পর বছর ম্যাক্সের দখলে থাকা ৪০ শতক ভূমি উদ্ধার করতে গেলে স্থানীয়দের রোষানলে পড়েন পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যা। এ সময় স্থানীয়রা এই কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করেন, ম্যাক্সের পাশে থাকা প্রতিটি দোকান থেকে ২ লাখ টাকা নিয়েছেন রেলওয়ে ও পুলিশের কর্মকর্তারা। যে কারণে বারবার তাদের উচ্ছেদ করা হলেও উচ্ছেদের পর আবারও বেদখল হয় সেই সব জায়গা। স্থানীয় ও সাংবাদিকদের জেরার মুখে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি। ফের দখল হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেলওয়ের সম্পত্তি কেউ দখল করে থাকলে উদ্ধার করা ভূসম্পত্তি বিভাগের কাজ, কিন্তু সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ এবং দেখেশোনার দায়িত্ব অন্য বিভাগের।

সরজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডসহ বেশ কিছু স্থানে লিজ নেওয়ার নাম করে একরের পর একর জমি দখল করে রেখেছে বেশ কয়েকটি শিল্প গ্রুপ। শিল্প গ্রুপগুলো কী পরিমাণ ভূমি দখল করে রেখেছে, তারও কোনো হিসাব নেই পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ভূসম্পত্তি বিভাগে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নতুন করে বেদখল হচ্ছে রেলওয়ের জমি। বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কার্যালয় থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে নগরীর ওয়্যারলেস কলোনি রোড এবং পাহাড়তলী কলেজ সড়ক। এই পায়ে হাঁটা পথ দূরত্বে রেলওয়ের জায়গা দখল করে নতুন নতুন দোকান উঠলেও দেখেও না দেখার ভান করছেন উদ্ধারকাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।  

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বিভাগীয় ভূসম্পত্তির তথ্য জানতে তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হয়েছেন এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে রয়েছেন বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা (সদর) নূর-এ-জান্নাত রুমি, বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যা এবং বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা, ঢাকা। তাদের কারও কাছ থেকেই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের হালনাগাদ কোনো তথ্য পাননি তিনি। বারবার যোগাযোগ করলেও কোনো তথ্য দিতে পারেননি পূর্বাঞ্চলের ভূমি বিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ট্র্যাক) মো. মনিরুজ্জামান।

তবে বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা, চট্টগ্রামের কার্যালয় থেকে অর্ধযুগ আগে হালনাগাদ করা একটি তথ্য বিবরণী থেকে জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগে মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২৪৩২ একর (কম-বেশি)। এর মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলভূমির পরিমাণ ১ হাজার ৩৬৭ একর। এই সড়কে অধিগ্রহণ করা ভূসম্পত্তির নামজারি হয়নি এখনো। তবে বিভাগীয় ভূসম্পত্তির কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম কার্যালয়ের নথিপত্রে বেহাত হওয়া ভূমির পরিমাণ ৮০ একরের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে বেদখল হওয়া ভূমি সম্পত্তির পরিমাণ আরও বেশি। 
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের (দোহাজারী-কক্সবাজার সড়ক ছাড়া) ১ হাজার ৬৪ একর ভূমির মধ্যে অপারেশনাল কাজে ব্যবহার করা হয় প্রায় ৫৫৮ একর জমি। কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয় ৩২৬ একর। এর মধ্যে কৃষি লাইসেন্সকৃত মোট জমির পরিমাণ ৩২১.৩৮ একর। কৃষি লাইসেন্স যোগ্য জমির পরিমাণ সাড়ে ৫ একর। বাণিজ্যিক লাইসেন্সকৃত জমির পরিমাণ ৪.৩২ একর (কল্যাণ ট্রাস্টসহ) এবং বাণিজ্যিক লাইসেন্স যোগ্য জমির পরিমাণ ২ একর। মৎস্য চাষ জমির পরিমাণ ২৬ একর এবং মৎস্য লাইসেন্স যোগ্য জমির পরিমাণ ৬ একর। নার্সারি জমির পরিমাণ ১০.৩২ একর এবং নার্সারি লাইসেন্স যোগ্য জমির পরিমাণ ৮ একর। সিএনজি স্টেশনের জন্য লাইসেন্সকৃত জমির পরিমাণ দেড় একর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য লাইসেন্সকৃত মোট জমির পরিমাণ ৯ একর এবং বিক্রীত জমির পরিমাণ ৫ একরের বেশি। অব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৩৯ একর।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল সূত্রে জানা গেছে, পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগে বেদখল হওয়া জমির পরিমাণ ৮০ একর। এর মধ্যে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক দখলীয় জমি ৩০ একর, বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক দখলীয় জমির পরিমাণ ৫ একর এবং ব্যক্তি দখলীয় জমির পরিমাণ ৪৫ একর।

বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল সক্রিয় এবং আন্তরিক দাবি করে পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার নাজমুল ইসলাম বলেন, বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে আমরা প্রতি মাসেই অভিযান পরিচালনা করি।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!