ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারি, ২০২৫

মুদি দোকানি থেকে হাজার কোটির হুন্ডি মুকুল

জনাব আলী, রাজশাহী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪, ০১:১০ এএম

মুদি দোকানি থেকে হাজার কোটির হুন্ডি মুকুল

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

এক দশক আগেও পাড়ায় মুদি দোকান চালিয়ে সংসার চালাতেন মুখলেসুর রহমান মুকুল। এখন তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক।

রাজশাহীতে তিনি পরিচিত ‘হুন্ডি মুকুল’ নামে। এতদিন তিনি আওয়ামী লীগের স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকেছেন। তাদের বিপুল টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এখন বিএনপি ও যুবদলের কিছু নেতা মুকুলের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে খোদ দলের পক্ষ থেকেই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

আওয়ামী জমানায় প্রভাব খাটিয়ে জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নে দুটি বালুমহাল ইজারা পান হুন্ডি মুকুল। সেই বালুমহালের ‘মধু খেতে’ এখন বিএনপি ও যুবদলের জেলা এবং মহানগরের কয়েকজন নেতা হুন্ডি মুকুলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ মাটিকাটা ইউনিয়ন বিএনপি। তারা বালুমহাল বন্ধের দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন।

মুখলেসুর রহমান মুকুলের বাড়ি রাজশাহী নগরের কাঁঠালবাড়িয়া গোবিন্দপুর মহল্লায়। তার বাবার নাম ওয়াজি মন্ডল। ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে আইজিপির কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। ‘হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হওয়া প্রসঙ্গে বিশেষ প্রতিবেদন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে হুন্ডি কারবারিদের তালিকা দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। ওই তালিকার রাজশাহীর সিন্ডিকেট প্রধান ও মূলহোতা অংশে ২ নম্বরে ছিল মুকুলের নাম। ২০১৮ সালের ওই প্রতিবেদনেও মুকুলকে মুদি দোকানের ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক দশক আগে পাড়ার মহল্লায় মুদি দোকান চালিয়ে সংসার চালাতেন মুকুল। ওই দোকানে বসেই তিনি বাংলাদেশি টাকা নিতেন। আর ভারতে মুকুলের লোকজন টাকার বিনিময়ে ভারতীয় রুপি দিতেন। এভাবে তিনি জড়িয়ে যান হুন্ডি কারবারে। হুন্ডি মুকুল মাধ্যম হয়ে ওই টাকা পরে চট্টগ্রাম ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতেন ভারতে।

তার সঙ্গে ভারতের অন্যতম চোরাকারবারি এনামুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এনামুলের বিপুল টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে মুকুলের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতের ইডি একসময় নগদ টাকা উদ্ধারে অভিযান শুরু করলে এনামুল বিপুল পরিমাণ ভারতীয় রুপি পাঠিয়ে দেন মুকুলের কাছে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অর্ধেক রুপি এনামুলকে ফেরত দেন মুকুল। আর বাকিটা মেরে দেন। পরে কয়েক দফা ভারতীয় লোকজন মুকুলকে খুঁজতেও এসেছিল রাজশাহী। কিন্তু তারা মুকুলের নাগাল পায়নি। এনামুলের মেরে দেওয়া বিপুল রুপি নিয়ে বিলাসী জীবন শুরু করেন রাজশাহীর মুকুল।

রাজশাহী ও ঢাকায় মুকুলের এখন চারটি বাড়ি। এ ছাড়া কাশিয়াডাঙ্গায় আছে সাততলা বাণিজ্যিক ভবন। আছে দুটি দামি গাড়ি এবং অন্তত ৪০ বিঘা জমি। এর মধ্যে শহরেই জমি আছে অন্তত ২০ বিঘা। এই জমির আনুমানিক মূল্য ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজশাহী সিটিহাট গরুর হাটেও আছে মুকুলের বড় অঙ্কের শেয়ার। দেশের বাইরে সৌদি আরবেও মুকুলের হোটেল ব্যবসার কথা শোনা যায়। মক্কা ও মদিনায় মুকুলের দুটি হোটেল আছে বলে ঘনিষ্ঠরা জানেন। গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশ পেলে বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন মুকুল। এরপর এলাকায় ফিরলেও ৫ আগস্টের পর আবারও গা-ঢাকা দিয়েছেন।

হুন্ডি মুকুলের মাথার ছাতা হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ। তারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে স্থানীয় প্রশাসন মুকুলের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি।

মুকুল তার কালো টাকা সাদা করতেন ঠিকাদারি ব্যবসায় নাম লিখিয়ে। অন্য ঠিকাদারদের টেক্কা দিয়ে অস্বাভাবিক বেশি দরে কাজ নিতেন তিনি। সাবেক মেয়র লিটনের আশীর্বাদে বেশি কাজ পেতেন সিটি করপোরেশনের। কাজে লোকসান হলেও দেখাতেন লাভের হিসাব। এভাবেই কালো টাকা সাদা করতেন মুকুল। বিপুল আয় দেখিয়ে আয়করও দিতেন। বেশি টাকা আয়কর দেওয়ায় ‘সুনাগরিক’ হিসেবে গত বছর মুকুলকে সম্মাননা দেয় কর অঞ্চল, রাজশাহী।

আসাদ এমপি হওয়ার পর হুন্ডি মুকুল আসাদের দুই ভাই মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শফিকুজ্জামান শফিক ও জেলা যুবলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক রফিকুজ্জামান রফিককে সঙ্গে নিয়ে গোদাগাড়ীর দুটি বালুমহাল বাগিয়ে নেন নিজের মুন এন্টারপ্রাইজের নামে। আওয়ামী সরকারের পতনের পর মুকুল, রফিক ও শফিক লাপাত্তা। বালুমহাল চালাচ্ছেন মুকুলের ভাই বাবু ও ভাতিজা সাজিম। বালুমহাল নিয়ে কয়েকদিন ধরে এলাকায় উত্তেজনা রয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে মুকুলের মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। হোয়াটসঅ্যাপেও তাকে পাওয়া যায়নি।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হুন্ডি মুকুলের প্রতিষ্ঠান বেশকিছু কাজ করছিল। এর মধ্যে পদ্মা নদীর বাঁধে ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকার ব্রিজ নির্মাণ, সিঅ্যান্ডবি মোড়ে ৫ কোটি ২ লাখ টাকায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণ, ২ কোটি ৮৪ লাখ টাকায় রাজশাহী জজ কোর্টের সীমানা প্রাচীর, ড্রেন, কার্পেটিং রাস্তা নির্মাণ, ৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকায় কেশবপুর দক্ষিণপাড়া, কোর্ট স্টেশন পূর্ব ও পশ্চিমের তিনটি জলাশয় সৌন্দর্যবর্ধন, ৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকায় মাদ্রাসা, স্কুল ও বুলনপুরের পুকুর সংস্কার, ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকায় ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে সিসি রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ, ১১ কোটি ১৮ লাখ টাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নির্মাণসহ বেশকিছু কাজ করছিলেন মুকুল।

এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণকাজ ৯০ শতাংশ সম্পন্ন দেখিয়ে বিল তুলেছেন ৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। অন্য কাজগুলোরও প্রায় অর্ধেক বিল তুলেছেন। অসমাপ্ত কাজগুলো এখন মহানগরের এক বিএনপি নেতা করতে চান। তিনি সিটি করপোরেশনকে তা জানিয়েছেন।

দায়িত্বপ্রাপ্ত এক প্রকৌশলী নিজের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, সম্প্রতি মিলু নামের এক ব্যক্তি নিজেকে বিএনপি নেতা পরিচয় দিয়ে জানিয়েছেন, মুকুল পলাতক থাকায় তার কাজগুলো তিনি করবেন। মুকুল তাকে কাজের দায়িত্ব দিচ্ছেন।

হুন্ডি মুকুল শেখেরপাড়া ও ফুলতলা এলাকার দুটি বালুমহাল ইজারা নিলেও এতদিন ক্ষমতার দাপটে বিদিরপুর এলাকায় অবৈধভাবে আরেকটি ঘাট খুলে পদ্মা নদী থেকে বালু তুলতেন। বালুর জন্য ইজারা হলেও নদী তীরের মাটি কেটে বিক্রি করতেন ইটভাটায়। এতে আশপাশের গ্রাম হুমকির মুখে পড়লেও প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না স্থানীয়রা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর স্থানীয় বিএনপি নেতাদের নিয়ে এর প্রতিবাদ শুরু করেন গ্রামবাসী। কিন্তু বিপত্তি বেধে যায় তখন, যখন জেলা ও মহানগরের কয়েকজন নেতা এই বালুমহালের পক্ষে অবস্থান নেন।

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বালুমহালে অবৈধভাবে মাটি কাটার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে এলাকাবাসী কয়েক দফা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। উপজেলা সদরে মানববন্ধনও করেন। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় গ্রামবাসী বালুমহাল বন্ধ করে দিয়েছেন।

এসব আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকেছেন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আহসানুল কবির টুকু ও উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুদ্দিন টমাস। এর জের ধরে গত ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহীর আদালত এলাকায় মারধরের শিকার হন ছাত্রদল নেতা সাইফুদ্দিন টমাস। মুকুলের ভাতিজা সাজিম ও জেলা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল সরকার ডিকোর নেতৃত্বে দুদফা হামলা হয় তার ওপর। সেদিন থেকেই টমাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।

টমাস জেলা বিএনপির শীর্ষ এক নেতার নাম জানিয়ে বলেন, ‘তিনি ফোন করে বলছেন মুকুল তার আত্মীয়। বালুমহালের কোনো অনিয়ম নিয়ে প্রতিবাদ করা যাবে না। তাকে ব্যবসা করতে দিতে হবে।’ টমাস বলেন, ‘আত্মীয়-টাত্মীয় কিছু না। তারা আসলে বালুমহালের মধু খেতে চান।’

যুবদল নেতা ডিকো সাংবাদিকদের বলেন, ‘যারা বালুমহাল বন্ধ করতে চায়, তারা আসলে চাঁদাবাজি করছে। চাঁদা না দেওয়ার কারণে টমাস বালুমহাল বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই কোর্ট চত্বরে পেয়ে লোকজন তাকে মারছিল, আমি গিয়ে তাকে রক্ষা করেছি। আমি মারিনি।’

রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ বলেন, ‘মুকুল যে সন্ত্রাসী লোক, আওয়ামী লীগের লোকÑ এটা আমরা জানি। ডিসি অফিসে তার পক্ষে কথা বলার জন্য আমাকে ধরেছিল, আমি বলিনি। তারেক রহমানের নির্দেশ কোনো আওয়ামী লীগের লোকের পক্ষে দাঁড়ানো যাবে না। তিনি বলেন, ‘হয়তোবা দু’একজন তার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে। এটা হতে পারে, অস্বাভাবিক নয়। কোনো রকমের কার্যক্রমে যদি আমাদের লোক জড়িত হয়, তাহলে দল ব্যবস্থা নেবে।

আরবি/জেডআর

Link copied!