সিরাজগঞ্জের তাড়াশে বেহুলা সুন্দরীর বাড়ি এবং জিয়ন্ত কূপ এখনো ইতিহাসের স্মৃতি বহন করে রয়েছে বিনসাড়া গ্রামে। জিয়ন্ত কূপ, বেহুলার স্নান করার মল পুকুর, ডুবন্ত নৌকার চিহ্ন এগুলো দেখতে সবসময় ভির লেগেই থাকে পর্যটকের। দেখতে এসে কৌতূহল জাগে এই কূপের ইতিহাস। অনেক পর্যটক আবার স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে চায় বেহুলার কূপের ইতিহাস ঐতিহ্য।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গোলআকৃতি চারিদিকে ইটের বেস্টনি, ভিতরে অনেক গভীর আর এই কুপের নাম জিয়ন্ত কূপ। এই কুপটি দেখতে বড় অদ্ভুত বড় বড় ইটের গাথুনী দিয়ে নির্মিত। যার একটি কূপের মধ্যে আরো ৪টি কূপ আছে। সাক্ষী করে রাখার জন্য নৌকার মতো একটি চিহ্ন দেখা যায়।
তথ্যমতে, উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের তৎকালীন নিচানী বাজার বর্তমানে বিনসাড়া গ্রামে। বাছোবানিয়ার একমাত্র রূপসী কন্যা ছিলেন বেহুলা সুন্দরী। বেহুলা সুন্দরীর বাড়ি এবং জিয়ন্ত কূপ এখনো তাড়াশে ইতিহাসের স্মৃতি বহন করে রয়েছে বিনসাড়া গ্রামে। এই গ্রামে ঐতিহাসিক নির্দশন, অসংখ্য পুরনো মন্দির, দালানকোঠা এখনও বিদ্যমান রয়েছে জনপথটিতে। চাঁদের বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই খালটি আজও আছে। বিনসাড়া গ্রামের লোকজনের মতে বেহুলার খাঁড়ি (খাল)। অল্প দূরে বড় একটি ইঁদারা (কূপ)। লোকমুখে এক কান থেকে দুকান হয়ে নাম হয়েছে বেহুলার কূপ। কেউ কেউ আবার বেহুলা পাড়াও বলে। এই বিনসাড়া গ্রাম ছিল বেহুলার বাবা বাছো বানিয়ার (মায়া সওদাগর) বাড়ি। অতীতে চলনবিলের এই এলাকা ছিল অরণ্যে ঢাকা। এক ঘর থেকে আরেক বসতি ছিল অনেক দূরে। সেসব এখন বিলীন। বর্তমান জনরণ্য। লোকমুখে এখনও শোনা যায়, এখানে ছিল বেহুলা সুন্দরীর বাড়ি। বেহুলার নাম এলেই আসে লখিন্দরের নামও। প্রেম-পরিণয়ের অমন জুটি আজও বাংলার লোকগাঁথার সম্পদ হয়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরে।
পাবনা ভাঙ্গুড়ার জাকিরুল ইসলাম নামের এক পর্যটক বলেন, আমি আত্মীয় বাসায় বেড়াতে আসছি আমার মূল উদ্দেশ্য বেহুলার কুপ দেখা দেখে খুব ভালো লাগলো।
আনোয়ার হোসেন নামের আরেক পর্যটক বলেন, আমি সিরাজগঞ্জের জামতৈল থেকে বেহুলার কূপ দেখতে আসছি অনেক শুনেছি এর ইতিহাস আজ সো চোখে দেখলাম।
স্থানীয় বাসিন্দা, সোহেল রানা জানান প্রতিদিন দূরদূরান্ত হতে প্রায় ৬০-৭০ জন লোকজন দেখতে আসেন। এখনে বেহুলার বাপের বাড়ি এই কুপে বেহুলা গোসল করতো। কেউ যদি অনুষ্ঠানের থালাবাসন চাইতো পরের দিন চাহিদা অনুযায়ী থালাবাসন কূপ থেকে উঠে আসতো।
আরেক স্থানীয় বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, বেহুলা র বাপের বাড়ি বিনসাড়া আর শুশুর বাড়ি বগুড়া মহাস্থানগড়, এখানে যে সোনার নৌকা ডুবে আছে এই সোনার নৌকা য় যাতায়াত করত তার পরিবার। তারা পরিবারসহ ডুবে যায় এখানে। আমার দোকানের পাশেই নৌকার আকৃতি হয়ে আছে। বেহুলার স্বামীরা ছিল সাত ভাই, তাদের সাপে কেটে মেরে ফেলে, শুনেছি এক পাগল ঐ সোনার নৌকা খুরতে চেষ্টা করছিলো পরে নাক মুখ দিয়ে রক্ত এসে মারা যায়। তারপর থেকে আর কেউ খুরতে যায় না।
জানা যায়, তাড়াশের বিনসাড়া গ্রামে বসতি ছিল বাছো বানিয়া বা মায় সওদাগরের। তারই একমাত্র কন্যা বেহুলা। রূপেগুণে অদ্বিতীয়া। প্রমথনাথ বিশি ও রাখাল দাসের বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে মায়া সওদাগর ও তার অপরূপ কন্যা বেহুলার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
বগুড়ার চম্পকনগরে আরেক সওদাগরের বাড়ি। নাম চাঁদ সওদাগর। তার ছেলেই লখিন্দর। চলনবিলের দক্ষিণ প্রান্তে বেহুলা আর উত্তর প্রান্তে সুদর্শন লখিন্দর বড় হতে থাকে। মায়া সওদাগর ও চাঁদ সওদাগরের ব্যবসারও প্রসার ঘটে। নৌপথে চলাচলের এক পর্যায়ে লখিন্দরের বজরা ভেড়ে বেহুলাদের বিনসাড়া গ্রামের কাছে। দেখা মেলে এক অপরূপ সুন্দরীর। চোখাচোখি হয়। লখিন্দর সেখানে চাঁদের বাজার স্থাপন করেন। এরপর বেহুলা-লখিন্দরের প্রণয় উপাখ্যান প্রাণ পায় পরিণয়ের পিড়িতে। পৌরাণিক উপাখ্যানে বেহুলার বাবা মায়া সওদাগর ছিলেন সর্পদেবী মনসার পূজারী।
অপরদিকে লখিন্দরের বাবা চাঁদ সওদাগর মনসাকে মানতেন না। এতে ক্ষুব্ধ হয় মনসা দেবী। সিদ্ধান্ত নেয় বাসর রাতেই লখিন্দরকে দংশন করবে। চাঁদ সওদাগর ছেলের জন্য লোহার বাসরঘর নির্মাণ করেন। মনসার কারসাজিতে বাসরঘর তৈরির কারিগরকে নির্বংশ করার হুমকি দেয় সর্পদেবী মনসা। ভয়ে ছোট্ট ছিদ্র রাখে কারিগর। বাসরঘরে সুযোগ বুঝে লখিন্দরকে দংশন করে সর্পদেবী। চলনবিলের এই উপাখ্যান ইতিহাসে নেই। এদিকে মৃত স্বামীকে বাঁচাতে কলার ভেলায় চলনবিলের এতটা পথ পেরিয়েছে বেহুলা, জানে না কেউ।
বিনসাড়া গ্রামের লোকজন বলেন, সেখানে বেহুলার বাবার তিনশ ষাটটি পুকুর ছিল। ৪০ বিঘা জমিজুড়ে ছিল মায়া সওদাগরের ভিটা। বড় একটি ইঁদারা আজও বেহুলার বাবার স্মৃতি বহন করছে। আছে বেহুলার কূপ। যে ঘাটে লখিন্দরের ময়ূরপঙ্খি বজরা ভিড়ত, তা শুকিয়ে এখন ছোট্ট খাল। বেহুলার খাঁড়ি আর ধারের চাঁদের বাজার আজও আছে। বেহুলার পৈত্রিক ভিটা, বিনসাড়া সরকারী প্রাথমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, ভূমি অফিস, বাজার, ঘরবাড়ি সবই আছে। লোকজন জানে এটাই বেহুলার বাড়ি। বিনসাড়া প্রাইমারি স্কুলের নামফলকে লেখা ছিল ‘ঐতিহাসিক বেহুলার বাড়ি’।
কথিত আছে অনিন্দ্য রূপে গুণের অধিকারিণী বেহুলা সুন্দরী বাবা বাছোবানিয়ার সঙ্গে প্রায়ই বাজার করতে আসতেন। বেহুলা যে বাজারে যেত তার নাম চান্দেরবাজার। প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর চান্দেরবাজার লাগোয়া তাড়াশের বস্তুল গ্রামে। যে বট গাছের নিচে বসে বেহুলা-লক্ষিন্দর গল্প করত সেই বট গাছটি এখনো বিশাল জায়গাজুড়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চান্দেরবাজার বস্তুলে এখন স্কুল-কলেজ, ভূমি অফিস, হাটবাজার গড়ে উঠেছে।
তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের বস্তুলে খাসজমির পরিমাণ প্রায় ৭০০বিঘা। একশ্রেণির প্রভাবশালীরা খাসজমিগুলো দখল করে নিয়েছে। কেউ কেউ নিজের নামে ওই সব খাসজমির কাগজপত্র তৈরি করে নিয়েছে। অনেকেই এসব সম্পত্তির ওপর দালান-কোটা তৈরি করে বসবাস করছে।
বস্তুলের ৭০০ বিঘা খাসজমির মধ্যে কিছু জায়গা নিয়ে আশ্রয়ন কেন্দ্র তৈরি করা হলেও অধিকাংশ জমি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। অথচ সরকারিভাবে এসব খাসজমি লিজ দিলেও সেখান থেকে প্রতিবছর সরকারের রাজস্ব আদায় হতো লাখ লাখ টাকা।
আরও জানা যায়, বিনসাড়া গ্রাম (তৎকালীন নিচানীবাজার) এক সময় জমিদারদের বড় শহর ছিল। এখানে ছিল বড় বড় অট্টালিকা। যার স্মৃতি এখনো মাটি খুঁড়লে পাওয়া যায়। এ গ্রামে মাটির নিচে আছে বহু ভূ-সম্পদ। সত্বী বেহুলার বাড়িতে আছে বেহুলার কূপ। ওই কূপের মধ্যে আছে আরো চারটি ছোট ছোট কূপ। এ কূপ নিয়ে রয়েছে নানান রকমের নানান জনশ্রুতি। শোনা যায় সব আর্শ্চয ঘটনা। যেমন এককালে এ কূপের পানি অসুখ-বিসুখে যে যে খেতো তার সুস্থতা ফিরে পেত।
আরও জনশ্রুতির ব্যাপার হলো, ওই এলাকায় যদি কারো বাড়িতে বিয়ে বা কোন অনুষ্ঠান হতো তার আগে কূপের সামনে গিয়ে বলে আসলে অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত থালা, গ্লাস, বাটি, ডেসকিসহ সবকিছু উপড়ে উঠে থাকত। ঘটনাক্রমে কোনো একদিন কোনো কুচক্রী লোক প্রয়োজন শেষে ওই সব বাসনপত্র ফেরত না দেওয়ায় সেই থেকে কূপ তার ডেকোরেটরের সুলভ আচরণ বদলে ফেলে। এ এলাকায় আছে অনেক ভূ-সম্পদ-যা সরকারভিাবে সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকাবাসী।
আপনার মতামত লিখুন :