ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কালের সাক্ষী মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি

ময়মনসিংহ ব্যুরো

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪, ০৬:১১ পিএম

কালের সাক্ষী মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি

মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সময়ের পালা বদলে সময় গেছে। ব্রিটিশের ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দি পেরিয়ে এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে পুরাতন আদল ধরে রেখে নতুন করে সাজানো হয়েছে এককালে প্রতাবশালী জমিদারদের আবাসস্থল মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়িকে ঘিরে পর্যটন জোন গড়ে তোলার দাবী এলাকাবাসীর। ইতিহাসখ্যাত মুক্তাগাছা রাজ পরিবার ও ভূ-স্বামীদের প্রতিষ্ঠাতা পুর্বপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ
আচার্য্য ১৭২৭ সালে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর অনুগ্রহ লাভ করেন। তিনি জমিদারী সদর দপ্তর বিনোদবাড়ীতে স্থাপন করেন। পলাশীর যুদ্ধের পরপরই আনুমানিক ১৭৬০ সালে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরীর পর ছেলে রামরাম, হরেরাম, বিষ্ণুরাম ও শিবরাম এ এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাদের পূর্ব-পুরুষগণ ছিলেন বগুড়ার অধিবাসী। কথিত আছে, শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরী জমিদারিত্ব নিয়ে এ এলাকায় আসার সময় মুক্তারাম কর্মকার নামের এক দরিদ্র প্রজা পিতলের সুবৃহৎ একটি দ্বীপধার (গাছা) দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানায়। রাজা খুশি হয়ে এক সময়ের বিনোদবাড়ি মুক্তারামের নামের সঙ্গে প্রদত্ত গাছার সঙ্গতি রেখে এ  এলাকার নাম দেন মুক্তাগাছা।
প্রজাদের উপর জমিদারদের নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনী যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রজাবৎসলের ইতিহাস। জমিদারবাড়ীর সামনে দিয়ে জুতা পায়ে ছাতা মাথায় দিয়ে কোন প্রজা গেলে জমিদারদের হুকুমে পাইক বরকন্দজরা তাদের ধরে এনে চাবুক মেড়ে এই দু:সাহসের সাজা দিত। এহেন শাস্তির ভয়ে প্রজারা জুতা, ছাতা বগলে নিয়ে রাজবাড়ীর আঙ্গিনা অতিক্রম করত। পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষিত ও প্রজাবৎসল জমিদারদেরও সংখ্যাও নেহায়েৎ কম ছিল না। শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরীর চার পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র শিবরাম আচার্য্য চৌধুরী বাবার ন্যায় পরম ধার্মিক ছিলেন। তিনি ১৭৭৬ সালে দেশময় খাদ্য সংকটের (মন্বন্তর) সময় মুক্ত হস্তে দান করে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষায় এগিয়ে আসেন। খুলে দেন রাজকোষের তালা, খাদ্য ভান্ডারের সকল দুয়ার। তার এ মহানুভবতার কথা আজও মানুষের মুখে মুখে গুঞ্জরিত হয়।
নাটোরের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রঘুনন্দন অপু এক বিধায় দত্তক নেন গৌরীকান্তকে।

গৌরীকান্তের পুত্র শশীকান্তের সহধর্মীনি রানী লক্ষীদেবী নিঃসন্তান হওয়ায় ফরিদপুরের মজুমদার বংশের সূর্য্যকান্তকে দত্তক পুত্র রূপে গ্রহণ করেন। এমনি ভাবে দত্তকরাই জমিদারী শাসন করে যায় যুগের পর যুগ। রাণী লক্ষ্মীদেবীর মৃত্যুর পর রাজবংশের জমিদারী চলে যায় কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে। ১৮৬৭ সালে সূর্য্যকান্ত জমিদারীত্ব ফিরে পান। পরবর্তীতে এই সূর্য্যকান্তই বৃহত্তর ময়মনসিংহের মহারাজা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি রাজশাহী জেলার কমর গ্রামের শ্রী ভবেন্দ্র নারায়ন চক্রবর্ত্তীর কণ্যা রাজরাজেশ্বরী দেবীকে বিয়ে করেন।

ময়মনসিংহের রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কাস তারই স্বাক্ষী যুগ যুগ ধরে বহন করে চলেছে। এ জেলায় বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার ইতিহাস এই প্রথম। জমিদার বাড়ির অভ্যন্তরে তার নামের সাথে সঙ্গতি রেখে তৈরী করেন মনোহর কারুকার্যময় এক মন্দির। নাম দেন রাজ রাজেশ্বরী মন্দির। সোনার গহনা দিয়ে জড়ানো হতো মন্দিরের অভ্যন্তরের প্রতিমা গুলোকে। জমিদারদের মধ্যে বিবাদ থাকলেও তারা প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান দূর্গা পূজা পালত করতেন এই মন্দিকে ঘিরেই। এ ছাড়াও তৈরী করেছিলেন পাথরের শিব মন্দির, রাম কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়, নগেন্দ্র নারায়ন বালিকা বিদ্যালয়।

ময়মনসিংহ পৌরসভা হওয়ার অনেক পূর্বেই জমিদারদের উদ্যোগে বেঙ্গল গভর্ণমেন্টের গেজেট নোটিফিকেশন জারীর মাধ্যমে মুক্তাগাছা ইউনিয়ন পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়। ঐতিহাসিক সেই গেজেট নোটিফিকেশনটি হল-The 21 st May 1878. It is hereby notified for general information that the Lieutenant-Governor has been pleased, in the exercise of the powers confrred on him by Section 8 of the Bengal Municipal Act, 1876, to extend to the Union of Muktagacha, in the
district of Mymensingh, the provisions of Chapters 1, II, and V of the Act, with effect from the Ist July 1878, and to declare that for the purposes of this Act, it shall be deemed to be a Second Class Municipality from the aforesaid date. প্রতিষ্ঠাকালীন পৌরসভায় ছয় জমিদার সূর্য্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী, অমৃত নারায়ন আচার্য্য চৌধুরী, যোগেন্দ্র নারায়ন আচার্য্য চৌধুরী, কেশব চন্দ্র আচার্য্য চৌধুরী, দূর্গাদাস আচার্য্য চৌধুরী ও কেদার কিশোর আচার্য্য চৌধুরী কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৭৬০ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত প্রায় দু’শ বছর এ এলাকায় জমিদারী প্রথা চালু ছিল। ১৯৫৬ সালে তদানীন্তন সরকার জমিদারী প্রথা বাতিল করলে একমাত্র জমিদার বকুল কিশোর আচার্য্য চৌধুরী ব্যতিত অন্যসবাই ভারতে চলে যান। তিনি মৃত্যুর পূর্ব অবধি এখানে অবস্থান করেন। এখানকার জমিদাররা ছিলেন অত্যন্ত সৌখিন ও শিকারী পাগল। তারা বসবাস ও রাজকার্য পরিচালনার জন্য তৈরী করেন সুউচ্চ একতলা ও দ্বিতল বিশিষ্ট ভবন। ছিল বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা। মধুপুর বনে সদল বলে তাঁবু গেঁড়ে তারা শিকার করত বড় বড় বাঘ, হরিণসহ হিংস্র প্রাণী। জমিদার মহলের সমগ্র আঙ্গিনা ছিল পাকা। হাতি সংগ্রহ ছিল তাদের নেশা। হাতিশালায় মাহুতরা থাকত সদা ব্যস্ত। কে কত বেশী হাতি তাদের হাতিশালায় সংগ্রহ করতে পারে এ নিয়ে চলতো প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা। দূর্গা প্রতিমা বিসর্জনে হত সাজানো হাতির মিছিল। সারা বছর জুড়ে চলত যাত্রা, নাটক, কবি গানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। দেশের বিখ্যাত শিল্পীদের পাশাপাশি ভারত থেকে আনা হত নামকরা শিল্পীদের। আয়োজন করা হত প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলা। ভারতের বিখ্যাত ক্লাব মোহনবাগান, ইষ্ট বেঙ্গল এতে অংশগ্রহণ করতো। সূর্য্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর বাড়িটি আজ শহীদস্মৃতি সরকারী কলেজ। ঐতিহাসিক সেই দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি পুরনো আদলেই নতুনভাবে সংস্কার করা হয়েছে। রাজা জগৎ কিশোর আচার্য্য চৌধুরীর বাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে আছে কালের স্বাক্ষী হয়ে। দুবৃর্ত্তরা রাতের আধাঁরে বিভিন্ন ভাস্কর্য, কাঠ, লোহাসহ মূল্যবান প্রত্নতত্ব সম্পদ লুণ্ঠন করে ফুঁকলা করে দিয়েছে রাজবাড়ি। মনকাড়া, দৃষ্টিনন্দন, কারুকার্য খচিত ভবনগুলো অযত্ন আর অবহেলায় আজ বিলুপ্তপ্রায়। এ বাড়ির ঠিক উত্তর পার্শ্বেই ছিল রাজা বিষ্ণুরামের বাড়ি। এখানে স্থাপন করা হয়েছে আর্ম পুলিশ ব্যাটালিয়ন। বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল বড় বড় অট্রালিকা।

এ ছাড়াও তারা জনকল্যাণে জেলার বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেছিলেন জনহিতকর প্রতিষ্ঠান। সেগুলোর মধ্যে ময়মনসিংহ শহরে কালিবাড়ি স্কুল, আলেকজান্ডার ক্যাসেল, মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা বিদ্যালয়, এস কে হাসপাতাল, টাউন হলসহ আরও অনেক। আনন্দ মোহন কলেজ বর্তমানে আনন্দ মোহন বিশ্ব বিদ্যালয় কলেজ স্থাপনেও ছিল তাদের উল্ল্যেখযোগ্য অনুদান। প্রজাদের গোসল ও খাবার পানির জন্য খনন করেন শতাধিক বড় বড় পুকুর সংস্কৃতি কর্মকান্ডে অবদান স্মরণযোগ্য। নাটকের জন্য জমিদার জগৎ কিশোর আচার্য্য চৌধুরীর অন্দর মহলের ভিতরে স্থায়ী ভাবে নির্মাণ করা হয় ঘূর্ণিয়মান মঞ্চ। যা ভারত উপমহাদেশে দুটির মধ্যে একটি। পরবর্তীতে তা স্থনান্তরিত হয়ে ময়মনসিংহ টাউন হলে প্রতিস্থাপন করা হয়। ছিল বাংলার অন্যতম বৃহৎ পাঠাগার, জীতেন্দ্র কিশোর লাইব্রেরী। র‌্যাগেলের মানচিত্র, বঙ্কিম চট্রপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রথম মুদ্রিত কপি, মীর মোশাররফ হোসেনের রচনার প্রথম মুদ্রিত কপি, রবীন্দ্র ভারতীর অসংখ্য প্রকাশনা, উপ মহাদেশের বিভিন্ন মানচিত্র, হস্তি চিকিৎসা বিষয়ক বই, কীর্তিমানদের আত্ম জীবনী, সংস্কৃত সাহিত্যের গ্রন্থাবলী, ভেষজ চিকিৎসার বই, উদ্যান বিষয়ক গ্রন্থসহ অসংখ্য সংগ্রহ ছিল সেলফে সেলফে ঠাঁসা। ১৯৬৪ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর মূল্যবান বহু গ্রন্থ বেহাত ও নস্ট হয়ে যায়। পরে দশ সহস্রাধিক গ্রন্থ উদ্ধার করে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ঢাকায় সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে গ্রন্থ গুলো জিতেন্দ্র কিশোর গ্যালারী নামে বাংলা একাডেমীতে সংরক্ষিত রয়েছে।

এ ছাড়াও তাদের বহু মূল্যবান ব্যবহার্য অলংকার, তৈজষপত্র, কাপড়-চোপড়, যুদ্ধাস্র, গন্ডারসহ বিভিন্ন পশুর চামড়া, হাতির দাঁতে বুনন শীতল পাটি ও বিভিন্ন উপকরণ বর্তমানে ময়মনসিংহ জাদু ঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। জমিদারদের ফেলে যাওয়া পরিত্যাক্ত সম্পত্তির উপর গড়ে উঠেছে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ গুলোর মধ্যে উপজেলা ভূমি অফিস, নবারুণ বিদ্যানিকেতন, এন এন পাইলট গার্লস হাই স্কুল,মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুকুল নিকেতন, কেন্দ্রীয় মসজিদ ও ঈদগাহ, মাঠসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। জমিদার জামাতাকে উপঢৌকন হিসেবে দেয়া মনোহর কারুকার্যে নির্মিত ভবন। ভবনের মেঝ ও সিঁড়ি মূল্যবান শ্বেত পাথরে ঢাকা।

এখানে চলছে উপজেলা সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের কার্যক্রম। প্রজাদের শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে প্রতিষ্ঠা করেন আর, কে, হাই স্কুল। তৎকালে এটিই ছিল স্থানীয় ভাবে একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরে এ বিদ্যালয়টি এতদাঞ্চলে খ্যাতির শীর্ষ স্থান লাভ করে।

জমিদারদের জমিদারী বিলীন হওয়ার সাথে সাথে তাদের বহু বিষয়সম্পত্তি ও কারুকার্যের বাসভবন, মন্দির,নাট মহল, সান বাঁধান ঘাটসহ মূল্যবান স্থাপনা গুলো হয়ে পড়ে জীর্ণ মলিন। ক্ষয়ে ক্ষয়ে হয়েছে কঙ্কাল। ভবনের ইট, সুরকী, আস্তর ধ্বসে পড়েছে। দেয়াল ছাড়াই শুধু খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে জানান দিচ্ছে তাদের অতীত অস্তিত্বের। কারুকার্য খচিত অট্রালিকাগুলোর মূল্যবান কাঠ, লোহা, পাথরসহ বিভিন্ন উপকরণ গুলো সুদুর চীন দেশ থেকে আনা হয়। আর তা গড়ার কারিগররাও ছিল সেদেশেরই।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্বাবধানে নেয়া হয়েছে জমিদারবাড়ীসহ রেখে যাওয়া অট্রালিকা, মন্দির ও তৎসংলগ্ন ভূমি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগেই পুরাতন আমলের
নির্মাণ শৈলী ঠিক রেখে সংস্কার করা হয়েছে এ জমিদার বাড়িটি। জমিদার বাড়িটি দেখতে যে কেউ আসতে পারেন যেকোন দিন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিনে রয়েছে এই জমিদার বাড়িটি।

আরবি/জেডআর

Link copied!