ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

কাজী জাফরের পুরো সম্পদ সেফজোনে

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২৪, ১২:৩২ এএম

কাজী জাফরের পুরো সম্পদ সেফজোনে

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে বন্দি। অন্যদিকে গত ১৫ বছরের শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কমিটি-পদ ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের পাহাড় গড়েছেন নিজে ও স্ত্রীসহ অন্যদের নামে। দেশে-বিদেশে কাজী জাফরের সম্পদের রয়েছে ‘সেফজোনে’। তার অবৈধ সম্পদ অর্জন, বিদেশে অর্থ পাচার এবং অপকর্মের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে। যদিও  দুদকের অনুসন্ধান চলছে নামমাত্র।

গতকাল পর্যন্ত দুদকের অগ্রগতির তথ্য পাওয়া যায়নি। আ.লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিক্সন চৌধুরী কাজী জাফরউল্লাহকে বিভিন্ন সভায় ‘চোর’ আখ্যায়িত করে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। নানা অভিযোগ থাকলেও দলীয় প্রধান তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং কাছে টেনে নেন। ফলে কাজী জাফর হয়ে উঠেন বাড়তি ক্ষমতার অধিকারী। ফরিদপুরের তিন উপজেলায় তার ছিল তিন খলিফা। টাকা সংগ্রহে ছিল ক্যাশিয়ার বা ব্যক্তিগত সহকারী মামুন আর রশীদ।
স্ত্রী-পুত্রসহ পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আসা গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ ছিলেন শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন নেতা। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড়। পানামা ও প্যারাডাইস পেপারাস কেলেঙ্কারিতে কাজী জাফর ছাড়াও স্ত্রী নিলুফার জাফরউল্লাহ এবং ছেলে কাজী রায়হান জাফরেও নাম এসেছিল। দলীয় প্রধানের ঘনিষ্ঠতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে কমিটি-পদ বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। সরকারি নিয়োগ বাণিজ্যের পাশাপাশি বড় বড় তদবিরের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। স্ত্রী-পুত্রের নামে দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতাদের অধিকাংশ আত্মগোপনে চলে যান। আচমকা সরকার পতনে কাজী জাফরউল্লাহ দেশ ছেড়ে পালাতে পারেননি। ঢাকায় লুকিয়ে ছিলেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় করা মামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে রয়েছেন কারাগারে। ২০১৮ সালের হলফনামায় তার পেশা শিল্পপতি উল্লেখ করা হলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি নিজেকে রাজনীতিক উল্লেখ করে প্রশ্নের জন্ম দেন। ৫ বছর সংসদ সদস্য এবং টানা ৮ বছর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য দায়িত্ব পালনের সময়ে দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় সদরপুর ও ভাঙ্গা থানার ওসির কাছে নির্বাচনি খরচ চেয়ে না পেয়ে তাদের তিনি নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে বদলি করান।

কাজী জাফর আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরে ফরিদপুর-৪ আসনের তিনটি উপজেলায় একচ্ছত্র প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেন। সারা দেশে আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনের কমিটি-পদ বাণিজ্য ও উপ-কমিটির নামে বহিরাগতদের দলে প্রবেশ করান। ফরিদপুর জেলায় পুলিশে নিয়োগ বাণিজ্য, সরকারি দপ্তরের টেন্ডার বাণিজ্য, বদলি-বাণিজ্য, হাট-ঘাট লিজ দেওয়া এবং বিভিন্ন প্রকল্পে কমিশনের মাধ্যমে সিন্ডিকেট সদস্যদের দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতেন।

ভাঙ্গা, সদরপুর, চরভদ্রাসন উপজেলার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পদ বিক্রি করতেন লাখ লাখ টাকায়। কাজী জাফরের ক্ষমতার প্রভাবে কেন্দ্রে অভিযোগ পড়লেও তার অনুসারীদের কোনো শাস্তি বা কমিটি ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। তার নির্দেশেই সেন্ট্রাল কমিটি কমিটি গঠন, বহিষ্কার এবং সম্মেলনের আয়োজন করতেন। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিজ পরিবারের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্টেডিয়াম করেন। মা-বাবা এবং দাদা-দাদির নামে দুই উপজেলায় প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনটি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি কলেজ এবং একটি স্টেডিয়াম। ভাঙ্গা উপজেলার কাউলিবেড়া ইউনিয়নে তার দাদার নামে কাজী ওয়ালীউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়, দাদির নামে কাজী শামসুন্নেছা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ভাঙ্গা পৌর এলাকায় তার বাবার নামে সরকারি কাজী মাহবুবউল্লাহ কলেজ এবং তার চাচার নামে ডা. কাজী আবু ইউসুফ স্টেডিয়াম রয়েছে। সদরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নে তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেগম কাজী জেবুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।

কাজী জাফর বেশিরভাগ সময় ঢাকায় অবস্থান করতেন। অন্যদিকে, তার নির্দেশে তদবির, নিয়োগ, বদলি এবং টেন্ডার বাণিজ্যের টাকা সংগ্রহ করতেন তিন উপজেলার তিন ‘খলিফা’ বা নিয়ন্ত্রক ৩ প্রতিনিধি। সদরপুর উপজেলার দায়িত্বে ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ফকির আব্দুর ছত্তার, ভাঙ্গায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আকরামুজ্জামান রাজা এবং চরভদ্রাসনে উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ইসহাক মিয়া। পুরো ফরিদপুর জেলায় প্রভাব খাটানো তিন খলিফার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ বা হিসাব-নিকাশ দেখাশোনা করতেন কাজী জাফরুল্লাহর ব্যক্তিগত সহকারী মামুন আর রশীদ।

গত নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, কাজী জাফরউল্লাহর সম্পদের পরিমাণ ৬২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৯ টাকা এবং নিট সম্পদের পরিমাণ ৬১ কোটি ৩৪ হাজার ৫১৭ টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে তার নিজের ৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৩৮ এবং স্ত্রীর ৬ লাখ ৭ হাজার ২২৭ টাকা দেখানো হয়েছে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের জমা করা অর্থের পরিমাণ যথাক্রমে ২১ লাখ ২৯ হাজার ৩৪ এবং স্ত্রীর নামে ৮৪ লাখ ৫ হাজার ৪৫০ টাকা। এ ছাড়া বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ারে কাজী জাফরউল্লাহর নামে ১ কোটি ৯৭ লাখ ৮২ হাজার ৬৭০ এবং তার স্ত্রীর নামে ১৩ কোটি ৭ লাখ ৯৩ হাজার ১৬০ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। কাজী জাফরউল্লাহর পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৫ লাখ টাকা, ৫৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫৭ হাজার ২৫১ টাকা (এফডিআর) এবং তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ১৪ কোটি ৬৮ লাখ ৪৯ হাজার ১১৮ টাকা (এফডিআর) এবং ৭৫ লাখ টাকার (সঞ্চয়পত্র)।

এছাড়া, কাজী জাফরউল্লাহর কাছে আরএমএমএল শেয়ার মানি হিসেবে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার টাকা রয়েছে। তাদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে যথাক্রমে ২১ লাখ ২৯ হাজার ৩৪ এবং স্ত্রীর নামে ৮৪ লাখ ৫ হাজার ৪৫০ টাকা। তাদের গাড়ি, অলংকার, আসবাব এবং আগ্নেয়াস্ত্রসহ আরও কিছু সম্পদ রয়েছে।

বার্ষিক আয়ের ক্ষেত্রে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও অন্যান্য ভাড়া বাবদ কাজী জাফরউল্লাহর আয় ৮৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭৩৫ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকে আমানত থেকে আয় ১ কোটি ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৪৯১ টাকা এবং চাকরি (ডিরেক্টর রিমুনারেশন) থেকে আয় ১২ লাখ টাকা। তার নিজের নামে ৯৩ হাজার ৯২১ টাকা ও স্ত্রীর নামে ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৪৩৭ টাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে। এ ছাড়া তার নামে ২ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৫ টাকা এবং স্ত্রীর নামে ৫০ লাখ ৪০ হাজার ৪২৫ টাকা সঞ্চিত রয়েছে। তবে কৃষি খাত ও ব্যবসা থেকে কোনো আয় দেখানো হয়নি।

২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তৎকালীন ফরিদপুর-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কাজী জাফরুল্লাহ। পরে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও কাজী জাফরউল্লাহ ফরিদপুর-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী হিসাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কাজী জাফরউল্লাহর স্ত্রী নিলুফা জাফরউল্লাহ। সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনেও নিক্সনের কাছে পরাজিত হন আওয়ামী লীগের এই প্রেসিডিয়াম সদস্য। কাজী জাফরউল্লাহ গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

আরবি/জেডআর

Link copied!