দেশের বির্তকিত ব্যবসায়ী শিল্পগোষ্ঠী এস আলম নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন বেসরকারী ব্যাংক থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ব্যাংকারদের অন্যায় ভাবে চাকরিচ্যুতির ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এলডিপির সভাপতি শিল্পপতি এম এয়াকুব আলী।
বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিনা অপরাধে এক দিনের নোটিশে একহাজারেরও অধিক বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাংকারদের চাকরিচ্যুতি একটি অশনিসংকেত বলে মনে করছেন এ রাজনীতিবিদ।
তিনি বলেন, গত একমাস ধরে চলতে থাকা আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের অবৈধ দখলে থাকা বিভিন্ন বেসরকারী ব্যাংক থেকে যে পরিমান অর্থ লোপাট করে দেশে বিদেশে পাচার করেছে সে দায়ভার কেন ব্যাংকারদের উপর বর্তাবে তা নিয়েও এম এয়াকুব আলী ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
দক্ষিণ জেলা এলডিপির এ নীতিনির্ধারক আরো বলেন, ইতোমধ্যে পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংকের হাজারো কর্মকর্তারা চারকি হারিয়ে দফায় দফায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। এসব কর্মসূচিতে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের এক হাজারেরও বেশী কর্মকর্তা অংশ নিচ্ছে। এই তিন ব্যাংকের পরিচালনায় ছিল বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। ব্যাংক তিনটি থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নিয়ে বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে এস আলমের বিরুদ্ধে যা এখনো বিচারাধীন। গত ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদসহ তার দোসররা বিদেশে পাড়ি জমান। এরপর ব্যাংকগুলোকে এস আলমমুক্ত করে পরিচালনা পর্যদ ঢেলে সাজায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এম এয়াকুব আলী বলেন, ইসলামী ব্যাংকের ৩৫০, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬৭২ জন ও ইউনিয়ন ব্যাংকের ২৬২ জনকে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাঁদের বহাল না করলে সামনে আরো কঠোর কর্মসূচিতে এলডিপি ব্যাংকারদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে মাঠে নামবে বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন।
তিনি আরো বলেন, জোর করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের হাজারো ব্যাংকাররা চাকরিতে নিয়োগ পাইনি। তাদের বৈধ প্রক্রিয়ায় চাকরি হলেও অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাদেরকে যেন পুনরায় চাকরিতে বহাল করা হয় সে ব্যাপারে ব্যাংক গুলোর সংশ্লিষ্ট পরিচালনা পর্ষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
উল্লেখ্য, ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘদিন এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকার পতনের পর ব্যাংক গুলোকে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আগেই ব্যাংক গুলোর বেশির ভাগ অর্থ নামে-বেনামে সরিয়ে নিয়েছে গ্রুপটি। এর ফলে ব্যাংক গুলোতে এখন তারল্যসংকটে ভুগছে। ব্যাংকের নথিপত্র ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এর আগে, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২৭ আগস্ট ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর নতুন স্বতন্ত্র পর্ষদ দায়িত্ব নিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শন করে জানায়, ব্যাংকটির ঋণের ১৮ হাজার কোটি টাকা বা ৬৪ শতাংশই নিয়েছে এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন এই পরিদর্শন করে, তখন ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি এস আলমের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের একজন, তার সময়ই ব্যাংকটি থেকে বিপুল অর্থ বের করে নেয় এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়লে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে নিজের হিসাবে থাকা পুরো টাকা তুলে নেন এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীও। গত ৮ অক্টোবরের পর তিনি আর ব্যাংকে যাননি, পদত্যাগপত্রও জমা দেননি। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ নিজেই। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে দেশে পরিচিত ছিলেন। আওয়ামী সরকারের পতনের পর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদকে এস আলম গ্রুপের হাত থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়, ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে ৩৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছেন এস আলম। ব্যাংকটির আমানত ৪৫ হাজার কোটি টাকা হলেও ঋণ ৬০ হাজার কোটি টাকা। অন্য ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে সেই টাকাও লুট করেছে এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকায় ব্যাংকটি এস আলমের ঘনিষ্ঠ ২৪ শাখা ব্যবস্থাপকসহ ১৯৪ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করেছে।
অপরদিকে, গত ২২ আগস্ট এস আলম গ্রুপের দখলে থাকা ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে আদেশ জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
একই সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের নতুন বোর্ড গঠন করে ৫ স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং ব্যাংকিং সুশাসন নিশ্চিতকল্পে ও জনস্বার্থে ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে নতুন এ পর্ষদ নিয়োগ করা হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। বাকি স্বতন্ত্র পরিচালকেরা হচ্ছেন মোহাম্মদ খুরশীদ ওয়াহাব, মো. আব্দুল জলিল, ড. এম মাসুদ রহমান ও মো. আবদুস সালাম। তাদের মধ্যে খুরশীদ ওয়াহাব অতীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মো. আব্দুল জলিল আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক।
আরেক স্বতন্ত্র পরিচালক ড. এম মাসুদ রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। অপর স্বতন্ত্র পরিচালক মো. আবদুস সালাম এফসিএ, এফসিএমএ একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট।
আপনার মতামত লিখুন :