ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

জনবল সংকটে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত

কামরুজ্জামান লিটন, সরিষাবাড়ী

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪, ০৭:৩০ পিএম

জনবল সংকটে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জনবল সংকটে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীর সংকটও প্রকট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে। এতে দূর্ভোগে পড়েছে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা। এক সময়ে সারাদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জন করা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। ২ জন মেডিকেল অফিসার দিয়ে চলছে দিনরাত তিন বিভাগের চিকিৎসা সেবা। সার্জারী, গাইনী, মেডিসিন সার্জারী, কার্ডিওলজী, চর্ম ও যৌন, অর্থোপেডিক্স বিষয়ে কনসালটেন্ট পদ শূন্য থাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এই অঞ্চলের আশপাশের সাধারণ মানুষ। জামালপুর সদর জেনারেল হাসপাতাল থেকে সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রায় ৩০ কিমি দূরে হওয়ায় এই অঞ্চলের আশ-পাশের রোগীদের একমাত্র ভরসা এই উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সটি। সরিষাবাড়ী উপজেলা ও পাশ্ববর্তী সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর, টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ীসহ জামালপুর সদরের প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের চিকিৎসা সেবার ভরসার স্থানটি পরিণত হয়েছে নিরাশায়। এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নাজেহাল অবস্থা যেন দেখার কেউ নেই। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রশাসনিক, বিশেষজ্ঞ ও জুনিয়র কনসালটেন্টসহ সব মিলিয়ে ২৯ জন ডাক্তার নিয়োজিত থাকে। কিন্তু বর্তমানে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬ জন কর্মকতা ও ডাক্তারের মধ্যে ২ জন প্রশাসনিক কাজে, ২ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট আর বাকি ২ জন মেডিকেল অফিসার রয়েছে। আর ১০ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ২ জন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটিতে সার্জারী, গাইনী, মেডিসিন সার্জারী, কার্ডিওলজী, চর্ম ও যৌন, অর্থোপেডিক্স বিষয়ে কনসালটেন্ট পদ শূন্য। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে একসাথে চারজন ডাক্তার বদলী হয়ে যায়। এই চারজনের মধ্যে ৩ জন উচ্চতর শিক্ষার জন্য ডেপুটেশন পান এবং আরেকজন তার নিজ জেলায় ও সম্প্রতি মেডিকেল অফিসার ডা. মেহেদি হাসান বদলী হন। চিকিৎসক সংকটের সাথে আরেকটি বড় সংকট হচ্ছে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর-কর্মচারী সংকট। হাসপাতালের আয়া ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর ৭টি পদের বিপরীতে আছে মাত্র একজন। ওয়ার্ড বয় ৫টি পদের বিপরীতে আছে মাত্র ২ জন। নাইট গার্ড দুইটি পদের বিপরীতে আছে ১জন, বর্তমানে আউটসোর্সিং নিয়োগপ্রাপ্ত কোন কর্মচারীও এখানে নেই।

অপরদিকে কর্মরতরা হচ্ছেন প্রশাসনিক পদে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে ডা. শফিকুল ইসলাম, আর.এম.ও (সহকারী সার্জন) ডা. মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম কর্মরত থাকার পাশাপাশি রোগীদের সেবা দিয়ে আসছেন। আর ১০টি পদে জুনিয়র কনসালটেন্ট এর মধ্যে শিশু বিভাগে ডা. রোকেয়া বেগম, এ্যানেসথেসিয়া বিভাগে শাহরিয়ার ইসলামসহ দুই জন কর্মরত রয়েছেন।সার্জারি ও গাইনী বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট না থাকায় এ্যানেসথেসিয়া বিভাগে শাহরিয়ার ইসলাম কোন সেবা দিতে পারছেন না। সপ্তাহে দুই দিন মাদারগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনি সার্জন ডাঃ রাশেদা পারভীন মুন্নি ও এ্যানেসথেসিয়া বিভাগে শাহরিয়ার ইসলাম সিজারিয়ান সেবা দিয়ে আসছে। এক সময়
সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ছিলেন গাইনি সার্জন ডা. রাশেদা পারভীন মুন্নি। 

এছাড়া এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে ১৭ জন থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন সহকারী সার্জন (প্যাথলজি) ডা. শারমিন সুলতানা ও ডা. সালেহা খানম। ২জন মেডিকেল অফিসার দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগ, আন্তঃবিভাগ এবং বহির্বিভাগের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণে ২ জন ডাক্তারের একেক দিন একজন ডাক্তার ২৪ ঘন্টাই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এতে করে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে অনেকেই চলে যাচ্ছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আশে পাশে প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলিতে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রাঙ্গণ থাকছে অপরিষ্কার। ওয়ার্ড বয় না থাকায় ভর্তিকৃত রোগীদের নানান কাজে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ সুত্র জানায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজার, নরমাল ডেলিভারি, এক্সরে, আল্ট্রাসাউন্ড, ইসিজি, অন্ত:বিভাগে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা, বহি:বিভাগ এবং ইমার্জেন্সি রোগীর সংখ্যার সেবার মান সহ ২০ ধরনের কাজের উপর দেশ সেরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এতে ২০২৩ সালের ৪৫০ টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে জানুয়ারিতে এইচএসএস স্কোরিং এ জাতীয় উপজেলা পর্যায়ে প্রথম ও এইচএসএস স্কোরিং এ সারাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থান অর্জন করে সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বর্তমানে জানুয়ারী মাসে ১৫ তম, ফেব্রুয়ারি তে ২৪ ও মার্চে ২৫তম স্থান পেয়েছে। এর আগের বছরে দেশের দশের মধ্যে ছিল এই কমপ্লেক্সে চলতি মাসগুলোর মাসিক স্কোরের তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। এক সময় চিকিৎসা সেবার মানের দিক দিয়ে দেশের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা আখিঁ আক্তার, ফারজানা জান্নাত, রোজি আক্তার, শাহরিয়ার সাদ্দাম, কামরুল ইসলাম লিটনসহ আরও অনেকে জানান, সকালে হাসপাতালে এসে টিকেট কেটেও ডাক্তার দেখাতে পারি নাই। পরে হাসপাতালের পাশে ক্লিনিকে ৪০০ টাকা ভিজিট কেটে ডাক্তার দেখাতে হয়েছে। এর মধ্যে আবার বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষাও করতে হয়েছে।আমাদের টাকা পয়সা নাই যে বারবার বাইরে ডাক্তার দেখামু। হাসপাতালে ভর্তি থাইকা ডাক্তারের খোজঁ পাইনা। হাসপাতালটিতে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে অতি দ্রুত ডাক্তার নিয়োগ করার দাবি জানান তারা। 

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিচ্ছন্নতা কর্মী আসমা বেগম বলেন, আমার বয়স ৫০ এর উপরে, আমার একার পক্ষে পুরো হাসপাতাল ঝাড়ু মুছা করতে কষ্ট হয়, নিজেই নানান রোগী ভুগতাছি। কোন কুল কিনারা না পাইয়া আমার স্বামী,ছেলে ও মেয়েদের দিয়েও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করি।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্তব্যরত নার্সরা জানান, একজন মেডিকেল অফিসার ২৪ ঘন্টায় তিনটি বিভাগে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালনকালে জরুরী মুহূর্তে ডেকে আনতে হয়। রোগীরা বিষয়টি না বুঝেই আমাদের সাথে বিভিন্ন সময়ে রাগান্বিত হয়ে পড়ে। ডাক্তার না থাকায় এতে করে সেবা দিতে গিয়ে নার্সদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে। 

সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. রবিউল ইসলাম জানান, ইচ্ছা ও আগ্রহ থাকলেও চিকিৎসক সংকট থাকায় দূরদূরান্ত থেকে আসা সাধারণ রোগীদের কাঙ্খিত সেবা দিতে আমাদের হিমসিম খেতে হচ্ছে। আমাদের এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনন্ত ৮ থেকে ১০ জন মেডিকেল অফিসারসহ আরো ২ থেকে ৩ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট নিয়োগ দেয়া জরুরী।

সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শফিকুল ইসলাম জানান, ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে ডাক্তার ও জনবল সংকট নিয়োগের জন্য বারবার চিঠি দিয়ে যাচ্ছি। ডাক্তার ও জনবল সংকট নিরসন হলে সাধারণ রোগীদের সেবার মান বৃদ্ধির সাথে সাথে ডাক্তার ও নার্সদের
উপরও চাপ কমবে।

আরবি/জেডআর

Link copied!