মাওলানা কমরুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী। ছিলেন সিলেট শহরে অবস্থিত হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। সদ্য বিদায় নিয়েছেন তিনি। কয়েকদিন আগে হয়ে গেলো তার বিদায় সংবর্ধনা। মাদ্রাসা ময়দানে সংবর্ধনায় জানা গেল তার শিক্ষক জীবনের অজানা অনেক কথা। বক্তব্য দিচ্ছিলেন বিদায়ী ও সংবর্ধিত হিসেবে। আবেগ আপ্লুত হয়ে তখন জানান অনেক তথ্য। সেই সাথে তার সহকর্মীরাও জানান অজানা অনেক কথা; যা নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর রীতিমতো আলোচনায় পরিণত হয়েছে।
শিক্ষক জীবনে মহানুভবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সর্বমহলের প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। `তার এ দৃষ্টান্ত বিরল ও অতুলনীয়। সচরাচর চোখে পড়ে না`- মন্তব্য করছেন নেটিজেনরা।
গত শনিবার তিনি শিক্ষক জীবনের ইতি টানেন। ৩৮ বছরের শিক্ষকজীবন শেষে অবসরে যাওয়ার দিনই তাকে দেয়া হয় সংবর্ধনা। সেখানে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বক্তৃতায় জানালেন, শিক্ষকজীবনের শুরু থেকে তিনি নিজের বেতনের বেশির ভাগ টাকাই মাদ্রাসায় দান করে দিতেন। প্রথম দিকে কোনো বেতনই নিতেন না। যখন অন্য শিক্ষকরা বেতন নিতেন, তিনি সেই বেতন তুলে মাদ্রাসার তহবিলে জমা দিয়ে দিতেন। মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত তাই করেছেন তিনি। তবে শিক্ষক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বেতনের সব অর্থ নিজে না নিয়ে তার একটি অংশ রেখে দিতেন শিক্ষার্থীদের জন্য। শুরুতে তার বেতনের টাকা দিয়ে মাদ্রাসায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হতো। পাশাপাশি ছাত্রাবাস পরিচালনায়ও ব্যয় করা হতো সেই অর্থ। এর বাইরে যখনই ছাত্রাবাসের ছাতদের খাবারের জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন পড়তো, তার সিংহভাগ মিটাতেন তিনি। এখনও তা অব্যাহত রেখেছেন।
এমনকি, মাদ্রাসার কাজে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তিনি যাতায়াত করলেও প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে কখনোই কোনো ভাতা বা টিএডিএ নেননি।
তিনি নিজেও বলেন, মাদ্রাসার একটি টাকাও কখনো কোনোদিন নিজের জন্য ব্যয় করেননি, নেনওনি। তার এই বক্তৃতার ভিডিও এখন নেট দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই সাথে প্রশংসা করা হচ্ছে সকল মহল থেকে।
তার পরিবারের নিকটজন মুফতি মাওলানা বেলাল আহমদ বলেন, ২০০০ সালের অনেক পরেও তিনি বেতনের টাকা পর্যন্ত নিতেন না। বরং মাদ্রাসার প্রয়োজনে নিজের তহবিল থেকে আরও ব্যয় করতেন। তিনি জানান, মাওলানা কমরুদ্দিন চৌধুরী পারিবারিক সম্পত্তির আয় দিয়ে চলেন। তিনি অপচয় বিমুখ।
বাসাভাড়া থেকে মাসে যে আয় আসে সেটি তার পরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্য যথেষ্ট। তাতেই তিনি সন্তুষ্ট।
মাওলানা কমরুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী প্রচারবিমুখ ও স্পষ্টবাদী মানুষ হিসেবে বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের আলেম সমাজের কাছে পরিচিত।
তিনি দেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, শামসুল উলামা আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ)-এর ৫ ম সন্তান। আল্লামা ফুলতলী (রহ.) ছিলেন দেশে বিশুদ্ধ কোরআন চর্চা শিক্ষার প্রথিকৃৎ। প্রখ্যাত বুজুর্গ ও পীরে কামেল। দেশে-বিদেশে তিনি `আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলাহ` নামে অধিক সমাদৃত ছিলেন। অসংখ্য মাদরাসা মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৮৩ সালে হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন আল্লামা ফুলতলী। ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে ১৯৮৫ সালে যোগ দেন মাওলানা কমরুদ্দিন চৌধুরী। ১৯৯৩ সালে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হন। সেই থেকে একটানা ৩১ বছর মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পদ সামলেছেন। সিলেটে ইসলাম শিক্ষা প্রসারে এই মাদ্রাসার ব্যাপক অবদান রয়েছে। মাদ্রাসাটি সরকারি এমপিওভুক্ত। মাদ্রাসার সুনাম সিলেট ছাড়াও সারা দেশব্যাপী সমাদৃত। এর পেছনে তার অবদান সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছর মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সকল পরীক্ষার তার মাদ্রাসা প্রশংসনীয় ফলাফল অর্জন করে সুনাম কুড়িয়ে আনে।
প্রতিষ্ঠার শুরুতে টিনের ছাউনির মাদ্রাসা ছিল এটি। আজ কয়েকটি বহুতল ভবন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নির্মিত হয়েছে নিজস্ব ছাত্রাবাস।দাখিল শ্রেণি থেকে অনার্স-মাস্টার্স ও কামিল মাদরাসায় রূপান্তর হওয়ার পুরো সময় এই প্রতিষ্ঠানকে অভিভাবক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এখান থেকে তৈরি হয়েছেন হাজারো আলেম এবং সমাজের হাজারো আলোকিত মানুষ।
তার ছাত্ররা জানান, ডিনি শিক্ষার্থীদের জন্য ছিলেন অভিভাবক। সকল শিক্ষার্থী তার কাছে ছিল নিজের সন্তানের মত। তাদের সুখ-দুঃখের কথা বলতে হতো না। তিনিই যেন আগে থেকে টের পেয়ে যেতেন।
মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা আবু সালেহ কুতবুল আলম বলেন, নিয়মনীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন। তিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। নির্ভরতার বটবৃক্ষ। অপচয় কখনই পছন্দ করতেন না।
আপনার মতামত লিখুন :