নিজের টাকা বা জায়গা জমি দিতে হয়নি কোনোটাই। জোরে-জব্বরে, ক্ষমতার জোর আর মন্ত্রীর ভয় দেখিয়ে দখল ও নামকরণ করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও আখাউড়ার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। বাদ যায়নি ঐতয্যবাহী মসজিদও। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা-মা ও তার স্ত্রীর নামে। সব গুলোর উদ্যোক্তা কারীগর ছিল আখাউড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র তাকজিল খলিফা কাজল। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজের নাম লিখে রাখতেন।
১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নুরুন নবী স্কুলেন নাম পরিবর্তন করে নিজের স্ত্রীর নামের সাথে মিলিয়ে নাম করণ করেন নাছরীন নবী স্কুল। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এম তাহের উদ্দিন চেয়ারম্যান।
২০১১ সালে বোর্ড থেকে স্কুলের সঙ্গে কলেজ খোলার অনুমতি পায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালে স্কুলের জায়গাতে মন্ত্রীর মায়ের নামে জাহানারা হক কলেজ খুলেন সাবেক মেয়র কাজল। ২০১৫ থেকে সরকার পতন পর্যন্ত টানা ৯ বছর সভাপতি ছিলেন কাজল। এখানেই শেষ নয় গত ১৩ ই মে ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শাহজাহান মিয়া মারা যাওয়ার পর ১১ জন প্রভাষককে টপকিয়ে সাবেক মেয়র কাজলের স্ত্রী লাইব্রেরীয়ান থেকে বসে যান অধ্যক্ষের চেয়ারে। এ নিয়েও জনমনে প্রশ্ন ছিল অনেক।
আখাউড়া পৌর এলাকা কলেজপাড়ায় গরুর বাজারের জায়গা ক্ষমতার বলে দখল করে প্রতিষ্ঠিত করে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবার নামে সিরাজুল হক উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে প্রায় ৮ শতাংশ জায়গা নিয়েও আছে নানান বিতর্ক। কেউ বলছে গরুর বাজারের জায়গা আবার কেউ বলছে ক্ষমতার জোরে দখল করা জায়গায় স্কুল দেওয়া হয়েছে। গরুর বাজারের প্রায় ৭ ফুট জায়গা দখল ও আরো কিছু জায়গাতে বালু দিয়ে বরাট করে প্রতিষ্ঠান করার পরিকল্পনা ছিল সাবেক এই মেয়রের।
গরুর বাজারের ৪১ শতাংশ জায়গা ইউনিয়ন পরিষদের নামে হলেও জোরে কৌশলে পৌরসভা সেটির ইজারা দিতেন। ইজারা থেকে বছরে ৩৬ লাখ টাকা নিয়ে যেত তারা। দিতেন না ভূমি ক্ষতিপূরণ বাবদ এক পয়সাও।
কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের সোনার বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম থাকায় গত ২২ বছর যাবৎ এমপিওভুক্ত হয়নি। নাম পরিবর্তন করে সোনার বাংলা সিরাজুল হক উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ করা হলে সহজেই মিলেছে এমপিওভুক্ত।
পানিয়ারূপের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে ৪ বার। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে নাম ছিল পানিয়ারূপ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯৭০ সালে পরিবর্তন করে দেওয়া পানিয়ারূপ উচ্চ বিদ্যালয়। এরপর ২০১৯ সালের ১৮ আগস্ট থেকে বিদ্যালয়ের নামকরণ হয় মন্ত্রীর বাবার নামে সিরাজুল হক উচ্চ বিদ্যালয়। ২০২১ সালে পরিবর্তন করে অক্টোবরে সিরাজুল হক স্কুল অ্যান্ড কলেজ হয়। সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক ২০০৩ সাল থেকে সরকার পতন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন।
আখাউড়া পৌর শহরের বাণিজ্যিক এলাকা সড়ক বাজার। বাজারের ব্যবসায়ীরা মিলে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বায়তুল আমান’ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হায়দার আলী এই মসজিদ নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালে এই মসজিদের উপরে নজর পড়ে মেয়র তাকজিল খলিফা কাজলের। পৌর সভার মসজিদ বলে কাজল নিয়ে যান পৌর সভার অধীনে মসজিদটি। পদের জোরে মসজিদের সভাপতি হন কাজল। বদলে ফেলেন মসজিদের নাম।এখানে লক্ষাধিক টাকা হস্তক্ষেপ করেন কাজল। সাবেক আইনমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য মন্ত্রীর স্ত্রী আমাতুল্লাহ হক রীনার নামের সাথে মিল রেখে মসদিদের নাম দেওয়া হয় আমাতুল্লাহ হক কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ।
সরেজমিনে দেখা যায়, সাত তলা ফাউন্ডেশনে মসজিদের কাজ চলমান থাকলেও চলছে ধীর গতিতে।
এখনো মসজিদের প্রায় সব জায়গায় খোলামেলা রয়েছে। কিছু পাশে লাগানো হচ্ছে ইট। ৪ শতক জায়গার উপর ৩ তলা মসজিদ থাকলেও কাজল মসজিদ পৌর সভার অধীনে নিয়ে পুরাতন মসজিদ ভেংগে নতুন করে জেলা পরিষদ থেকে বাজেট হওয়া ২৮ লাখা টাকায় কাজ শুরু করেন ৬ তলার। ২০২০ সালে মসজিদের কাজ শুরু হলে মাটি খননের পর ২ বছর কাজ বন্ধ থাকে। পুর্বে পুরাতন মসজিদের নিচ তলায় ৬ টি দোকান থাকলেও কাজল বর্তমানে ৯ টি দোকান করে ৭ টি দোকানের বরাদ্দ করে প্রায় ৪০ লাখ টাকা নেন। মসজিদের হিসাব নিকাশে ছিল কাজলের থাবা। ধারনা করা যাচ্ছে মসজিদ দখলে নেওয়া তার আর্থিক লাভের চিন্তা ভাবনা ছিল।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মেয়রকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ হলে গত (৩ সেপ্টেম্বর) সড়ক বাজারের ব্যবসায়ীরা পৌরসভায় গিয়ে প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে মসজিদের বিষয়ে কথা বলেন। এ সময় তারা ৫শ’ জনের স্বাক্ষরিত একটি আবেদনও দেন। এরপরই ৬ই সেপ্টেম্বর জুমার দিনে মাইকিং করে মসজিদ কমিটি করা হয়। এবং পুনরায় আগের নামে মসজিদের নামকরণ করা হয়।
আপনার মতামত লিখুন :