রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও ভবন সংকটে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। এমন খবর পেয়ে সোমবার সকাল সাড়ে ৯ টায় চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে উচ্চ রক্তচাপের রোগী নজরুল ইসলাম চারঘাট হাসপাতালের বর্হিবিভাগের এনসিডি কর্নারের সামনে বসে আছেন চিকিৎসক দেখাতে ও ওষুধ নেওয়া জন্য। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা এসে দুই ঘন্টা অপেক্ষা করে বাড়ি গেছি। পুরো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খুঁজেও ডাক্তার-ওষুধ কিছুই পাইনি। আজকেও আমিসহ অনেক রোগী এসে অপেক্ষা করছি। ৯টায় ডাক্তার বসার কথা থাকলেও সকল ডাক্তারের রুম তালাবদ্ধ। একই অভিযোগ করলেন সানোয়ারা বেগম, মর্জিনা খাতুনসহ অনেক রোগী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিন বছর আগে ৩১ শয্যার রাজশাহীর চারঘাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ১০০ শয্য রুপান্তর করা হয়। ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতালের তিন তলা ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২২ সালের ২২ মে। নতুন ভবন নির্মাণ করতে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট পুরনো দ্বিতল ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ পরবর্তী এক বছরের (২২ মে ২০২৩) মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এক বছরের কাজ গত আড়াই বছরেও বুঝে পায়নি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কতৃপক্ষ। এ অবস্থায় এক্সরে, ইসিজি ও সনোরোজিষ্ট মেশিনসহ যাবতীয় সরঞ্জাম থাকলেও ভবনের সংকটে দীর্ঘ ধরে এসব সেবা বন্ধ হয়ে আছে। মেশিনগুলোও নষ্ট হবার উপক্রম। দিনের পর দিন ভোগান্তিতে পার করছেন রোগী ও চিকিৎসকরা।
এদিকে ভবন সংকটের পাশাপাশি চিকিৎসক ও কর্মচারী সংকটে হাসপাতালের সেবার কার্যক্রম আরো বেশি ভেঙে পড়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ছয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত চারঘাট উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষের চিকিৎসার প্রধান অবলম্বন এই হাসপাতাল। এই হাসপাতালে ৩১টি চিকিৎসক পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৭ জন, শুন্য রয়েছে ২৪টি চিকিৎসকের পদ। পাঁচজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র একজন, আয়ার দুইটি পদও শুন্য। প্রায় এক বছর ধরে মেডিসিন, কার্ডিওলোজি, অর্থপেডিক্স, সার্জারি, ইএনটি, অপথোমেলোজি ও সাজারি বিভাগে চিকিৎসক নেই।
এছাড়া দেখা যায়, পুরনো তিনতলা ভবনের নিচতলা হাসপাতালে বর্হিবিভাগ ও জরুরি বিভাগ হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। ছোট ছোট রুমে চিকিৎসকরা রোগী দেখছেন। প্রতিদিন ৩৫০-৪৫০ জন রোগী গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে চিকিৎসক সংকটে অধিকাংশ রোগী হাসপাতালে ঘুরে ক্লিনিকে যাচ্ছেন চিকিৎসা নিতে। ছোট্ট একটি রুমে প্যাথোলজির পরীক্ষার কাজ চলছে। এক্স-রে ও আল্টাসনোগ্রাফী মেশিন স্থাপনের জায়গা না থাকায় টেকনোলজিস্টরা পরীক্ষার কাজ বাদ দিয়ে টিকেট বিক্রি করছেন। একই ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় গাদাগাদি করে ভর্তি রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার ভায়ালক্ষীপুর এলাকার আলতাফ হোসেন বলেন, পেট অসহ্য ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলাম। কিন্তু মেডিসিন বিশেষজ্ঞ নেই কাকে দেখাবো। শিশু বিশেষজ্ঞ ছাড়া কোনো চিকিৎসক নেই। এজন্য অপেক্ষা করে ফেরত যাচ্ছি রাজশাহী শহরে ক্লিনিকে ডাক্তার দেখানো ছাড়া উপায় নেই। হাজার টাকা ভিজিট দিয়ে রোগী দেখানো আমার মত ভ্যান চালকের পক্ষে অসম্ভব।
রাওথা এলাকার বাসিন্দা রুনা বেগম বলেন, আমার ছেলে গাছ থেকে পড়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে। হাসপাতালে এসে দুই ঘন্টা অপেক্ষার পর জানলাম এখানে অর্থপেডিক্সের কোনো চিকিৎসক নেই। চিকিৎসক না পেয়ে একজন উপ-সহকারী ডাক্তারকে দেখানোর পর তিনি এক্স-রে পরীক্ষা দিয়েছেন। হাসপাতালে পরীক্ষাও হয়না। বাইরে ক্লিনিক নিয়ে যাচ্ছি পরীক্ষা করানোর জন্য। চিকিৎসক নেই, পরীক্ষা নেই, হাসপাতাল বন্ধ রাখা উচিত।
হাসপাতালের রেডিওলোজী বিভাগের টেকনোলজিষ্ট আবু তাহের বলেন, গত দুই বছর ধরে এক্স-রে ও আল্টাসনোগ্রাফী বন্ধ। মেশিন থাকলেও ভবনের সংকটের কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছিনা। শুয়ে বসে দিন কাটছে কিন্তু রোগীদের সেবা দিতে পারছিনা।
নবনির্মিত তিনতলা ভবনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট প্রকৌশলী পিযুষ মন্ডল বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতায় কাজ শেষ হতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ। কয়েকদিনের মধ্যেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কতৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের চারঘাট উপজেলার সভাপতি মো. কামরুজ্জামান বলেন, সারাদেশের মধ্যে সেবা প্রদানে কয়েকবার দেশসেরা হয়েছে চারঘাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অথচ নানা সংকট ও অবহেলায়-অনাদরে সেই হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা আজ বন্ধের পথে। বার বার বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মিলছেনা।
চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক রেজা বলেন, চিকিৎসক ও ভবন সংকটের কারণে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নতুন ভবন বুঝে পেলেও সেখানে কাজ শুরু হতে কিছুটা বিলম্ব হবে। কারণ সেখানো কোনো আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। চিকিৎসক ও যাবতীয় সরঞ্জামের আবেদন উর্ধতন কতৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :