স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ময়মনসিংহে চলছে রমরমা মামলা বাণিজ্য। নাশকতাসহ ভুয়া মামলায় আসামি করা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে। এতে লেনদেন হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এ নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে জেলাজুড়ে। তবে পুলিশ বলছে, বিভিন্ন মামলায় নিরীহরা আসামি হয়ে থাকলেও তাদের হয়রানি করা হচ্ছে না। চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হবে তাদের নাম।
গত ৫ আগস্টের পর জেলায় ৩১টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। এতে ১ হাজার ৮২৬ জনের নামসহ ৫ হাজার ৮৭৫ থেকে ৭ হাজার ১৯৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় ২০০ জনের বেশি আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১০ সালে ডান হাতের কবজি কেটে নেওয়া হয় লুৎফুর রহমানের (৪২)। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের করা নাশকতার মামলায় বেশ কয়েক মাস জেলও খাটেন তিনি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলায় আসামি হয়েছেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার ঘোগা ইউনিয়নের টানা তিনবারের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য লুৎফুর।
নাশকতার অভিযোগ এনে গত ৩০ আগস্ট মুক্তাগাছা থানায় সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাবুসহ ৯২ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত ১৪০০-১৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন দাওগাঁও ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলাম।
এ মামলায় ২২ নম্বর আসামি বুলবুল (৪৫), ৮৪ নম্বর আসামি লুৎফুর রহমান (৪৫) এবং ৯০ নম্বর আসামি মুন্নাফ মিয়া কামাল (৪০) বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারা সবাই উপজেলার ঘোগা ইউনিয়নের বাসিন্দা ও বিএনপির কর্মী। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তারা মামলা, হামলা, জেলখাটাসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন।
ভুক্তভোগী লুৎফুর রহমান বলেন, ‘আমি টানা তিনবারের ঘোগা ইউপির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ২০১০ সালে একই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক দুলাল আমার একটি হাত কেটে ফেলে, অন্যটি ক্ষতিগ্রস্ত করে। এখনো বাঁ-হাতটি স্বাভাবিক হয়নি। অন্যের সহযোগিতায় চলতে হয়। ২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাহবুবুল আলম মনি বাদী হয়ে আমাকে প্রধান আসামি করে নাশকতার মামলায় আসামি করে। গত আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটলেও আমার নামে নাশকতার মামলা হয়। বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর জেলা পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করে এখন বাড়িতেই থাকছি।’
আরেক ভুক্তভোগী মুন্নাফ মিয়া কামাল বলেন, ঘোগা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুজ্জামান লেবুর পক্ষে অবস্থান না নেওয়ায় আমাকে নাশকতার মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে। এটি কখনওই কাম্য হতে পারে না।
মামলার বাদী দাওগাঁও ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দের নির্দেশে এই মামলায় সবাইকে আসামি করা হয়েছে। তবে মামলায় বিএনপির তিনজন থাকার বিষয়ে আমি অবগত নই। এটা তারা বলতে পারবেন।’
নাশকতার মামলায় শুধু বিএনপির কর্মীরাই নন গত ১২ নভেম্বর দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর মাহমুদ আলমের দায়ের করা মামলায় ফেরারি আসামি হয়ে বাড়িছাড়া সদর উপজেলার নিলক্ষীয়া গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল মজিদ (৫৮)। ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি বিএনপির হরতাল সফল করার লক্ষ্যে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নাশকতা সৃষ্টি করায় তৎকালীন কোতোয়ালি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আলী আকবর বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায়ও তাকে ৫ নম্বর আসামি করা হয়।
ভুক্তভোগী আব্দুল মজিদ বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোনো দলই করি না। আমি একজন ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমাকে বিএনপি বানিয়ে নাশকতার মামলায় আসামি করা হয়েছে; এখন আমাকে আওয়ামী লীগ বানিয়ে বিএনপির অফিস পোড়ানোর মামলায় আসামি করা হলে আত্মগোপনে চলে যাই। কেন আমার সঙ্গে এমনটি হচ্ছে, আমারও তো সংসার-সমাজ রয়েছে।’
গত ৪ আগস্ট মহানগরীর শম্ভুগঞ্জ বাজারে ককটেল বিস্ফোরণ, গুলি ও হামলা-ভাঙচুর চালিয়ে দোকান লুটের অভিযোগ এনে কোতোয়ালি মডেল থানায় পাঁচ-সাতজনের নামে অভিযোগ দেন ব্যবসায়ী হামিদ মন্ডল। কিন্তু ১১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১০০-১৫০ জনকে আসামি দেখিয়ে গত ১ ডিসেম্বর নথিভুক্ত করে পুলিশ। মামলা হওয়ার পরপরই হামিদ মন্ডলের একটি অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে হামিদ মন্ডলকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি মামলা করিনি, কীভাবে মামলা হলো তাও জানি না। আমার দোকান ভাঙচুরের মামলায় আসামি অন্য কেউ ছিল।’
মামলার বাদী হামিদ মন্ডল বলেন, ‘মামলা আমার অজান্তে হয়েছে; এর জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু কে বা কারা করেছে তা বলতে পারব না। যেহেতু মামলা হয়েছে, আমি তা শেষ করে দিচ্ছি। আমার দোকান ভাঙচুরে তারা দায়ী নয়।’
মামলার বিষয়ে কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম খান বলেন, বাদীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই মামলা করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখব, সেখানে যদি কেউ নিরপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে তাদের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হবে।
জেলার তারাকান্দার নলদীঘি গ্রামে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিনের হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা হয়েছে গত ২৮ সেপ্টেম্বর। এতে আসামি করা হয়েছে একই পরিবারের পাঁচজনকে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ ঘটনাস্থল তদন্ত না করেই বাদীপক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে মামলা দায়ের করেছে। পুলিশের এমন মামলা বাণিজ্যে হতভম্ব ভুক্তভোগী পরিবারসহ স্থানীয়রা।
ময়মনসিংহের তারাকান্দা-ধোবাউড়া সড়কের নলদীঘি গ্রামের ফয়েজ উদ্দিনদের সাড়ে ১০ শতাংশ জমি ২০০৮ সাল থেকে জোরপূর্বক দখল করে রেখেছিলেন তারাকান্দা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুমন বিকাশ সরকারের চাচাতো ভাই নিল্টন চন্দ্র সরকার। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা তার দখলে থাকা জমিটি উদ্ধার করে, এ সময় করা হয় ভাঙচুরও। এ ঘটনা ২৮ সেপ্টেম্বর দেখিয়ে ফয়েজ উদ্দিনসহ পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৮-১০ জনকে আসামি করে তারাকান্দা থানায় মামলা করেন নিল্টন চন্দ্র সরকার।
মামলার আসামি এমদাদুল হক বলেন, ‘ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আমাদের সাড়ে ১০ শতাংশ জমি বেদখল দিয়ে নিল্টন চন্দ্র সরকার দীর্ঘ বছর ভোগ করে আসছিল। বিষয়টি এলাকার ছোট-বড় সবাই অবগত। এ নিয়ে সালিশও হয়েছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে ছাত্র-জনতা আমাদের জমিটুকু উদ্ধার করে দেয়।’
এ নিয়ে নিল্টন চন্দ্র সরকার বেশ কয়েকবার মামলা করারও চেষ্টা করে; কিন্তু তারাকান্দা থানার তৎকালীন ওসি বিষয়টি অবগত থাকায় মামলা নেননি। নতুন ওসি এসেই বিষয়টি তদন্ত না করে বাদীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আমাদের নামে ভুয়া মামলা করে হয়রানি করছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আলাল উদ্দিন বলেন, ভাঙচুর ৫ আগস্ট হলেও ২৮ সেপ্টেম্বর তা দেখিয়ে মামলা করা হয়েছে। তবে মামলা নেওয়ার ক্ষমতা ওসি স্যারের, তিনিই ভালো বলতে পারবেন।
তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. টিপু সুলতান বলেন, ‘এটি একটি সাধারণ মামলা, তা নিয়ে মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ করার কিছু নেই। বাদী-বিবাদী মামলাটি আপোসের পথে হাঁটছে। না হয় আমরা তদন্ত করে ফাইনাল রিপোর্ট দেব।’
জেলা পুলিশ সুপার মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক মামলায় নিরপরাধ কেউ আসামি হয়ে থাকলেও পুলিশ তাদের হয়রানি করছে না। এমন ঘটনায় আমার কার্যালয়ে বেশ কয়েকজন এসে দেখাও করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে বলে দিয়েছি, তাদের যেন হয়রানি না করা হয়। চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হবে তাদের নামও।’
আপনার মতামত লিখুন :