মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪, ০৭:২২ পিএম

banner

থানচিতে খাবারে সংকট কাটেনি ২১ গ্রামে

আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪, ০৭:২২ পিএম

থানচিতে খাবারে সংকট কাটেনি ২১ গ্রামে

দুর্গম মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় আদিবাসীদের কয়েকটি গুচ্ছ গ্রাম। গত শুক্রবার থানচি রেমাক্রী ইউনিয়নে মেনহাত পাড়া থেকে তোলা। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় গ্রামগুলোতে এখনো খাদ্যসংকটের দুর্বিষহ অবস্থা কাটেনি। তাছাড়া সীমান্তে গ্রামগুলোতে খাদ্য সমগ্রী পৌঁছাতে রীতিমত একটা বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রশাসনসহ সহযোগীতাদের। যার কারণে সীমান্তের ২১টি পাড়ায় দুই হাজারো অধিক মানুষের খাবারের সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে সেসব গ্রামবাসীদের চিন্তার ভাজ যেন চোখেমুখে।

থানচি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে সাঙ্গু নদী উৎপত্তিস্থলের কাছাকাছি  মায়ানমার সীমান্তবর্তী ঘেষা দুর্গম এলাকা ২১টি গ্রাম। সেখানে যেতে সময় লাগে প্রায় তিনদিন যা খরচ লাগে ২০ হাজার অধিক টাকা।  সীমান্তবর্তী ঘেষা দুর্গম এলাকাতে বসবাস করছেন ম্রংগং পাড়া, চই ক্ষ্যং পাড়া, লংগ্রী, য়াংবং নিচের পাড়া, য়াংবং উপর পাড়া, পাথর ঘাট পাড়া ,লিংপুং পাড়া, অনিমুখ পাড়া( মথিপাড়া), লিক্রি ম্রো পাড়া, লিক্রি ত্রিপুরা পাড়া, মালুম গ্যা পাড়া,কংকং(ফয়ক্ষ্যং) পাড়া, নামা পাড়া, নতুন পাড়া, পারাও পাড়া, রইওয়াই পাড়া, পানঝিড়ি পাড়া, চন্দ্রমহন পাড়া, তাংখোয়াই, বুলু পাড়া, মেনহাত পাড়াসহ গ্রামে প্রায় ৬৪টি পরিবার। সেসব গ্রামে জনসংখ্যা দুই হাজারে অধিক ম্রো ও মারমা সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। তাদের প্রধান খাবার হিসেবে নির্ভর করে জুম ধানের উপর। কিন্তু গতবছর ভয়াবহ বন্যার কারণে সেসব দুর্গম এলাকা গুলোর প্রায় সবকটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষদের জুমের পাকা ধান বন্যায় ভেসে গিয়ে ক্ষতি হয়েছে। তাদের অনেকের জুম থেকে ১০কেজির পরিমাণ ধান ঘরে তুলতে পারেনি। তাই গেল বছরে ধান ঘরে জমা না থাকায় এই খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।

গত আড়াই মাস ধরে বেঁচে থাকার তাগিদে সেসব গ্রামে ৫শতাধিক (শিশু-বৃদ্ধ) জীবন-যুদ্ধ করে চলেছে চালের সাথে বনের আলু ও বাঁশকোড়ল মিশ্রিত তরল খাবার  খেয়ে। তাছাড়া গ্রামগুলোতে প্রতিটি পরিবারের ৬-৮ সদস্যের জন্য একপট চালের সাথে বনের আলু, বাঁশকোড়ল মিশিয়ে পাতলা খাবার বানানো হয়। জুমের নতুন ধান আসার আগ পর্যন্ত এসব খাবার খেয়ে কোনরকম বেঁচে থাকার প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এই দুর্গম এলাকার মানুষেরা। অতিদুর্গম এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও বর্ষাকালের বৈরী আবহাওয়ার কারনে স্থানীয় বাজার বা হাটে আসতে না পারা পাশাপাশি ঘরে থাকা চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী কিনতে না পারায় এমনটি দুর্ভিক্ষ হয়েছে।

থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন বলেন, এলাকাটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও অতি দুর্গম হওয়ায় খাদ্য সাহায্য পৌঁছাতে রিতিমত একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িঁয়েছে। সেখানকার মানুষদের কি সমস্যা সেটা জানতেও বিরাট একটা ব্যাপার। তার মধ্যে যে পাড়াগোলোতে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে সেখানে নেই কোন নেটওয়ার্ক। একমাত্র নৌকা ছাড়া যাতায়াতের বিকল্প কোন পথ নেই। তাই সেসব এলাকায় যাওয়া এবং যোগাযোগ করা বড়ই কঠিন।  খাদ্য সংকটের খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের পর জেলা প্রশাসক ও রেমাক্রী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে আলোচনা করে ঐ এলাকায় ২মেট্রিক টন  জরুরি খাদ্য সামগ্রী পাঠিয়েছি। এরপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া  ছাত্রসংগঠের মাধ্যমেও ৪মেট্রিক টন খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠিয়েছি। তবুও প্রশাসন থেকে যা যা সহযোগীতা প্রয়োজন সেটি করে যাচ্ছি।

বেশ কিছুদিন আগে খবর ছড়িয়েছে থানচি সীমান্তের মিয়ানমারের কাছাকাছি রেমাক্রি ইউনিয়নের ৬ ও ৯ নং ওয়ার্ডের মেনহাত পাড়া, বুলু পাড়া, ইয়ংদং পাড়া ও তাংখোয়াইং পাড়া, ম্রংগং পাড়াসহ আশপাশের ২১ টি পাড়াতে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ঘরে চাল   না থাকায় ভাতের বিকল্প হিসেবে প্রায় এক-দেড় মাস যাবত বাশঁ কোড়ল (কচি বাঁশ) খেয়ে বেঁচে আছে পাড়ার বৃদ্ধ-শিশুসহ সকলের। এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করতে চলতি মাসের শুক্রবার সীমান্তের পাড়াগুলোর উদ্দেশ্যে রওনা দেয় স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি দল। সঙ্গে থানচি  উপজেলার বলিপাড়া ৩৮ ব্যাটালিয়নের ২০ জন বিজিবি সদস্যের একটি টিমও ছিল।

বুলু পাড়া থেকে ১ঘন্টা পাহাড়ী পথে পায়ে হেটে বাংলাদেশের সর্বপূর্বে শেষ গ্রাম মেনহাত পাড়া। সাংবাদিকদের দলটি কয়েক ঘন্টা হাটার পর মিয়ানমারের সীমানার কাছে মেনহাত ম্রো পাড়াতে পৌঁছায়। এটি ম্রো সম্প্রদায়ের অধ্যুষিত একটি গ্রাম। এই পাড়ায় মোট ১৪টি বসতবাড়ীতে ১৮টি পরিবারের বাসবাস। সবাই ম্রো সম্প্রদায়ের। বাড়িঘরগুলো বাঁশের খুটি, বেড়া ও বাঁশের পাতা দিয়ে তৈরি আর বেশিরভাগ ঘর জরাজীর্ণ। সেসব ঘরে পরিবারগুলো  অল্প চালের সাথে বাঁশকোড়ল মিশিয়ে পাতলা খাবার খেয়ে বেঁচে আছে। দূর্ভিক্ষ দিনে সাংবাদিকদের পাশাপাশি গ্রামে মানুষদের সহযোগিতা করতে বুলু পাড়া বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডারসহ এগিয়ে আসেন।

৩৪ ব্যাটালিয়নের জোন কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাইমুর রহমান খান বলেন, এলাকা গুলো অত্যন্ত দুর্গম, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও বিপদজনক হওয়ায় সেখানকার জনমানুষের বাস্তবতা ও দুর্বিষহ জীবনের তথ্য সঠিক ভাবে আসেনা বলেও জানান তিনি।

থানচি রেমাক্রি ইউনিয়নে দুর্গম এলাকা সেসব পরিবার জুম এবং বাগানের উপর নির্ভরশীল। তাদের  প্রধান খাদ্য উৎপাদনের উৎস জুম চাষ। প্রতিটি পরিবারগুলো জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। জুম চাষ করে সেসব পরিবারের খাদ্যে যোগান জোগায়। যেদিন জুমে নতুন ধান ঘরে উঠে সেদিন নিশ্চিন্তে খাবার খেয়ে জীবনযাপন করে চলে। কোন পরিবার একবেলা খেতে চাল লাগে দেড় কেজি আবার কারো দুই কেজি চাউল প্রয়োজন পড়ে। জুমের ধান ফলন ভালো না হলে কারো কাছ থেকে ধার নিয়ে সংসারে হাল টানতে হয়। কিন্তু গত বছরে সেসব সীমান্তবর্তী এলাকায় অতিবৃষ্টি হওয়ায় বন্যায় জুমের ধান নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে গ্রামগুলোতে খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। একদিকে সেসব পরিবারে ঘরে ধান ও চাল শেষ, অন্যদিকে বৃষ্টি ও বন্যার কারনে থানচি বাজারে যেতে পারছে না। যার কারণে এদিনে খাবার সংকটে মুখোমুখি হতে হয়েছে ২১টি পরিবারে।

মেনহাত পাড়া বাসিন্দা রেংওয়ে ম্রো জানান, পরিবারে চারজন সদস্যের একবেলা খেতে চাল লাগে দেড় কেজি। তারা তিনবেলা খাবার খান। গত এক মাস আগে বাড়িতে ১০ কেজির একটু বেশি চাল ছিল। ওই চাউল জুমের নতুন ধান না আসার আগেই শেষ হয়ে  যাবে। সহায়তা পাওয়া চাল তাড়াতাড়ি শেষ হলে খাদ্য সংকটে পড়তে হবে তার পরিবারকে। চাউলের পরিমাণ কমিয়ে তিনবেলা খাবারের বদলে একবেলা খেতে আধা কেজি চাউল দিয়ে সঙ্গে বাঁশ কোড়লের পরিমাণ বাড়িয়ে কোনমতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে পরিদর্শ করে এসে সংবাদ প্রকাশিত করে গনমাধ্যম কর্মীরা। এরপর প্রশাসন ও বিভিন্ন ছাত্র সমাজে শিক্ষার্থীরা সহযোগীতা এগিয়ে আসে। রেমাক্রি ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যের মাধ্যমে ১০ কেজি করে দুইবার চাউল এরপর ম্রো ছাত্র সংস্থার মাধ্যমে ২৫ কেজিসহ সবলিয়ে তিনবার ত্রাণ দেওয়া হয় সেসব সীমান্তবর্তী পরিবারদের মাঝে। কিন্তু সেসব পরিবারদের কপালে চিন্তার ভা্জ এখনো রয়ে গেছে। কেননা তিনবারে ত্রাণ পাওয়া চাউল প্রায় শেষের পথে। জুমের ধান এখনো পুরোপুরি পাঁকেনি। ধান পাঁকতে আরো ১২-১৫ দিন সময় লাগবে। ওই সময় পর্যন্ত তার পরিবারকে কোন মতে খেয়ে না খেয়ে জুমের পাঁকা ধানের জন্য অপেক্ষা প্রহর গুনতে হবে।

আরেক পাড়ার বাসিন্দা দৌনক ম্রো জানান, তিনবারে ত্রাণ পাওয়া ৪৫ কেজি চাউলও প্রায় শেষের পথে। এরপর হয়তো কারো কাছ থেকে ধার করতে হবে নয়তো জুমের আধা-পাঁকা ধান কেটে সেটাকে সেদ্ধকরে অথবা ভেজে ঢেকিতে ভেঙে খাওয়া ছাড়া কোন উপায় খুজে পাচ্ছেন নাহ।

বুলু পাড়া গ্রামে মাচাং ঘরের নিচে ঢেকিতে ধান ভাঙছে এক নারী। দেখেই বুঝা গেলো ধানগুলো পরিপক্ব হওয়ার আগেই কেটে নিয়ে আসা হয়েছে। ভাঙ্গানোর শেষে ঝুড়িতে রাখা  চালগুলো দুই -তিন টুকরো করে ভাঙ্গা আবস্থায় জমা রাখা হচ্ছে। রাতে একবেলা রান্নার পর ঘরে চাল শেষ। আগামী দিনগুলোর জন্য গতকাল জুমে গিয়ে  আধা-পাকা ধান কেটে নিয়ে এসে রোদে দিয়ে হালকা শক্ত হওয়ার পর আজ ভাঙছে। সেসব চাউল দিয়ে জুমের ধান পরিপক্ব না হওয়ার পর্যন্ত কোন মতে খেয়ে জুমের পাঁকা ধানের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।

সীমান্তবর্তী এলাকার বুলুপাড়া কারবারী (পাড়া প্রধান) বুলু ম্রো বলেন, আমাদের গ্রাম, মেনহাত পাড়া ও অন্যান্য গ্রামগুলোতে পরিদর্শনে এসে সংবাদ প্রকাশের পর সরকার থেকে দুই ধাপে পর ২৭কেজি আর আদিবাসী ছাত্রদের কাছ থেকে ২৫কেজি চাল,১কেজি নাপ্পি,২কেজি লবন ও ১কেজি শুটকি পেয়েছি। আর আমার পরিবারে ৮জন সদস্য আছে। আমার মত প্রত্যকে পরিবারে ৬-১২জন সদস্য আছে। পরিবারে দিনে ৪-৫কেজি চাল প্রয়োজন হয়। আমার ঘরে এখন ৪কেজি আছে। এরপর কি হবে সেটাই ভাবছি।

রেমাক্রি ইউপি চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা সাথে যোগাযোগ করা হলেও মোবাইল  ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, থানচি উপজেলায় দুর্গম এলাকায় খাদ্যাভাবের কথা জানি। ইতোমধ্যে উপজেলা ইউএনও কে সব ধরনের সহযোগিতার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলেছি। এবং পহাড়ে যেহেতু, প্রতিবছর জুন-আগস্ট  অর্থাৎ পাহাড়ে জুমচাষীদের জুমে নতুন ধান ঘরে না তোলার পর্যন্ত খাদ্য সংকট থাকে। তাই একটি নোট লিখে রাখতে বলেছি। যেন বদলী হয়ে পরবর্তীতে কেউ স্থলাভিষিক্ত হলেও যেন এই সহযোগিতা দিতে পারে।

আরবি/জেডআর

Link copied!