‘আমার কথাই শেষ কথা। আমার ওপর দিয়া অরা কেউ কথা কয় না। আমাগো বিরুদ্ধে কিছু কওয়ার মতো পিরোজপুরে কেউ নাই। রাজনীতি বলতে খালি আমরা চার ভাই-পরিবারই
আছি। যা কিছু করি আমরাই করি।’ পিরোজপুর সদর আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম আব্দুল আউয়াল নিজের মুখে বেশ দম্ভ নিয়েই কথাগুলো সাংবাদিকদের বলছিলেন তার ক্ষমতা কালে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের দক্ষিণ জনপদের জেলা পিরোজপুরে এক রাজনৈতিক পরিবারের রাজত্বের ও অপকর্মের চিত্র। তার ভাইদের মধ্যে সবার ছোটজনের নামই মহারাজ। তাঁর ওপরে আছেন আরো দুই ‘রাজা’। আর সবার ওপরে আছেন এক ‘মহারাজা’। গত ১৫ বছর এই ‘রাজপরিবারের’ হাতেই শাসিত হয়েছে পিরোজপুর। কারো সাহস ছিলোনা এই পরিবারের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করার। কেউ কেউ এক-আধটু ঘাড় ঘোরানোর চেষ্টা করলেই তাদের হতে হয় ‘রাজ্যছাড়া’, থাকতে হয় নির্বাসনে কিংবা কৌশলে ‘মটকে’ দেওয়া হয় ঘাড়। আবার কেউ সব হারিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে না থাকার মতো। পিরোজপুরে এসব অপকর্মের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে দেশে যখন গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লব হয়। দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে পিরোজপুরের প্রভাবশালী ‘রাজা পরিবারের’ সদস্যদের খোঁজ নেই। তারা সবাই রয়েছেন গা ঢাকা দিয়ে। এর মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা
একেএমএ আউয়াল। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একেএমএ আউয়াল ছাড়াও গা ঢাকা দেন তাঁর মেজো ভাই পিরোজপুর পৌরসভার চারবারের মেয়র মো. হাবিবুর রহমান মালেক এবং সেজো ভাই পিরোজপুর সদর উপজেলার দু’বারের চেয়ারম্যান মো. মুজিবুর রহমান খালেক। তাদের স্ত্রী-সন্তানও রয়েছেন আত্মগোপনে।
প্রভাবশালী এই রাজা পরিবারের সদস্যরা কে কোথায় তা জানা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরদিন বিকেলে পাড়েরহাট সড়কে একেএমএ আউয়াল ও হাবিবুর রহমান মালেকের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। সন্ধ্যার পর মুজিবুর রহমান খালেকের বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। তবে হামলার আগে রাজা পরিবারের তিন ভাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। সেই থেকে তারা আত্মগোপনে। রাজা পরিবারের ছোট ছেলে এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মশিউর রহমান মহারাজ সরকার পতনের আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। একেএমএ আউয়াল ১৯৭০ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য এবং ১৯৭১ সালে তৎকালীন পিরোজপুর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি যুবলীগের আহবায়ক এবং পরে সভাপতি হন। ১৯৭১ সালে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ২০০৮ ও ২০১৪ সালে পিরোজপুর-১ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন একেএমএ আউয়াল। তাঁর স্ত্রী লায়লা পারভীন এখন পিরোজপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ক্ষমতার অপব্যহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির বহু অভিযোগ রয়েছে এই রাজা পরিবারের বিরুদ্ধে। ২০২০ সালে দুদকের মামলায় একেএমএ আউয়াল ও তাঁর স্ত্রীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়ার পর পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল
মান্নানকে আইন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। দায়িত্ব পান পিরোজপুরের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ-২ নাহিদ নাসরিন। তাঁর আদালতে জামিন পান একেএমএ আউয়াল ও তাঁর স্ত্রী লায়লা পারভিন। বিষয়টি নিয়ে তখন সমালোচনার ঝড় ওঠে। মেয়র মো. হাবিবুর রহমান মালেক জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি। তিনি ২০০৪ সালে প্রথম পিরোজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর পর ২০১০, ২০১৫ এবং ২০২১ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন।
অভিযোগ রয়েছে, এসব নির্বাচনে ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে তিনি কাউকে প্রার্থী হতে দেননি। রাজা পরিবারের আরেক সন্তান মো. মুজিবুর রহমান খালেক জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি ২০১৪ ও ২০১৯ সালে পিরোজপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তাঁর স্ত্রী সালমা রহমান হ্যাপী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ২০২২ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিরোজপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। সাবেক এমপি আউয়ালের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান মহারাজ পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি এক সময় পিরোজপুর জেলা বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন। সব মিলিয়ে পিরোজপুরের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ব্যাপক ক্ষমতাশালী যে রাজা পরিবার, সেই পরিবারের সদস্যরা এখন লাপাত্তা! এক সময় যে বাড়িতে প্রতিদিন হাজারো মানুষের আনাগোনা ছিল, সেই বাড়িতে এখন পোড়া গন্ধ। আউয়াল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং খাসজমি দখলের তিনটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক। হাবিবুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী নিলা রহমানের বিরুদ্ধেও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা রয়েছে বলে সুত্র
জানায়। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় রাজা পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আপনার মতামত লিখুন :