ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সুস্থকে প্রতিবন্ধী বানিয়ে অর্থ আত্নসাৎ করেন সমাজসেবা কর্মকর্তা রাজ্জাক

হাসানুজ্জামান হাসান, কালীগঞ্জ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৪, ০৩:২৭ পিএম

সুস্থকে প্রতিবন্ধী বানিয়ে অর্থ আত্নসাৎ করেন সমাজসেবা কর্মকর্তা রাজ্জাক

সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সুস্থ- সবল মানুষদের প্রতিবন্ধী বানানো, স্বামী থাকতেই বিধবা বানানো! অল্প বয়সেই বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করাসহ নানা ধরনের অসাধ্যকে সাধন করতেন সদ্য অন্যত্র বদলি হওয়া লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। টাকা আছে তো সুবিধা আছে। টাকা হাতে করে অফিসে গেলেই মেলে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড। ডাক্তারকে মেটানোর দায়িত্বটাও সমাজসেবা কর্মকর্তারই। রাজনৈতিক প্রভাব ও নিজের কুকৌশল কাজে লাগিয়ে অসাধ্যকে সাধন করেন আব্দুর রাজ্জাক নামের এই সমাজসেবা কর্মকর্তা।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রাজ্জাক চাকরির পাঁচ বছরে কোটি টাকার সম্পত্তের মালিক হয়েছে। যোগদানের পর হতে গড়ে তুলেন একটি সিন্ডিকেট। সংক্রামক ও ক্যান্সারের মত জটিল রোগীর চিকিৎসা সহায়তার ভুয়া ফাইল করে আর্থিক অনিয়ম করে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

লালমনিরহাট ২ কালীগঞ্জ- আদিতমারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের একান্ত কাছের ব্যক্তি ছিলেন তিনি। এতে করে স্থানীয়রা তাকে কখনোই কিছু বলতে পারেনি। হাজার পাঁচেক টাকা হলেই সুস্থ’ মানুষকে প্রতিবন্ধী বানিয়ে কার্ড করে দেন। এছাড়া কার্ডধারীদের সরকার প্রদত্ত ভাতা বছরের পর বছর তুলে নেন এমন বহুত অভিযোগ তার বিরোধে।

এ কাজে তার হয়ে কাজ করে থাকেন চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং গ্রাম পর্যায়ের বেশকিছু আওয়ামী নেতা। অনলাইনে আবেদনের পর যাচাই- বাছাই ছাড়াই প্রতিবন্ধীর কার্ড ইস্যুর ব্যবস্থা করেন তিনি। এমনও গ্রাম আছে, যেখানে বেশির ভাগ ভালো মানুষ কার্ডধারী প্রতিবন্ধী। গোপনে তারা সরকার প্রদত্ত ভাতা পান। অথচ গরিব পরিবারের প্রকৃত অনেক প্রতিবন্ধী টাকার অভাবে কার্ড করতে পারেননি।

কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিসের অনিয়ম- দুর্নীতি ওপেন সিক্রেট হলেও যেন দেখার কেউ নেই। এসব ব্যাপারে উপরের কর্মকর্তার কাছে মৌখিক অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। ফলে এ উপজেলায় সমাজসেবা অফিসের অনিয়ম- দুর্নীতি দিন দিন বেড়েই চলছে। নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রতিবন্ধী ভাতাভুক্ত হতে অনলাইনে আবেদনের পর যাচাই -বাছাইয়ের মাধ্যমে কেবল প্রতিবন্ধীদের সুবিধাভোগী হিসেবে তালিকাভুক্তকরণ এবং প্রতিবন্ধী পাওয়া না গেলে বরাদ্দ অর্থ ফেরত দেওয়ার কথা। কিন্তু সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক নীতিমালার তোয়াক্কা করেননি।

সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অনেকের সাথে কথা হয় যাচাই-বাছাইয়ের দিন লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদন কপিসহ প্রয়োজনীয় কাজপত্র উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার হাতে দেন। আশায় ছিলেন অসহায় ছেলের নামে এবার প্রতিবন্ধী ভাতা হবে! কিš‘ পরে দেখেন অনেক সুস্থ সবল ও স্বচ্ছল লোকজন প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা পেলেও তাদের কপালে ভাতা জোটেনি। ঘুষের টাকা না দেওয়ায় ভাতা হয়নি।

উপজেলার প্রায় সব কয়টি ইউনিয়নে এ রকম প্রতিবন্ধী ভাতাবঞ্চিত অসংখ্য পরিবারের দেখা মেলে। 

আবার অনেকের নামে কাগজে টাকা উঠেছে কিন্তু তারা জানেন না। তথ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে ২০২৩ /২৪ অর্থবছরে মজুরিকৃত বিশেষ অনুদানের চেক ১১৩১ জনের ক্রসড ( সোনালী ব্যাংক লি. মগবাজার শাখা ঢাকা-(সুষ্ঠুভাবে বিতরণ দেখা হয়। টাকার পরিমান-১,২৩, ৬৯,০০০ এবং হতদরিদ্র খাতে একই ব্যাক্তি দুই, তিন, চারবার ও বিভিন্ন অনুদান পেয়েছে। 

কিন্তু বাস্তবে অনেকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, এরকম কোন আবেদন তারা করেননি। এই হতদরিদ্রদের নাম দিয়ে কে এই টাকা উত্তোলন করল। সেখানে দেখা যায় অন্যত্র বদলি হওয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল মান্নান ও সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকের সই করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে এক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক দালাল নিয়োগ করে টাকার বিনিময়ে সুস্থ ও স্বচ্ছলদের নামে প্রতিবন্ধী তালিকা প্রণয়ন করেন। তাই প্রকৃত প্রতিবন্ধীরা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। মাইকিং করে ডেকে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

সদ্য অন্যত্র বদলি হওয়া কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ভাই আমি তো বদলি হয়ে অন্য যায়গায় এসেছি বুঝতেই তো পারছেন সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ও তাদের কর্মীরা বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে আমার দ্বারা এসব কাজ করিয়েছে। আমার কি করার আছে আপনি বলেন ভাই। 

এভাবে বলে চটপট করে ফোন কেটে দেয় এবং পরে কথা বলবে বলে জানান। কিন্তু পরে তার সাথে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি এ বিষয়ের জন্য কোন সাড়া দেননি।

এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জহির ইমামের সাথে কথা হলে তিনি জানায়, তদন্ত সাপেক্ষে যদি এ ধরনের কোন কাজের সাথে লিপ্ত থাকার সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে সম্প্রতি সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের নামেও দুদকে মামলার অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!