ঢাকা বুধবার, ০৮ জানুয়ারি, ২০২৫

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাতে ধানের বাজার

জনাব আলী, রাজশাহী

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৭, ২০২৫, ০১:৪৭ এএম

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাতে ধানের বাজার

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আমনের ভরা মৌসুমে বেড়েছে চালের দাম। রাজশাহী জেলার চালকলগুলোতে বেশি উৎপাদিত হয় কাটারি, জিরাশাইল, নাজিরশাইল ও মিনিকেট চাল। মিলারের উৎপাদিত মোটা ও চিকন চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৬ থেকে ১০ টাকা। এক সপ্তাহে প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা।

তবে চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দুষছেন মিলাররা। তারা বলেছেন, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি বেশি দামে ধান কিনছেন তারা। সেই ধানের কিছু অংশ চাল উৎপাদনে বিক্রি এবং বেশির ভাগ অংশ স্টক করে রাখায় উৎপাদিত চালের দাম বাড়ছে।

ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকরা জানান, কৃষকের কাছ থেকে বাড়তি দামে ধান মজুদ করেছেন অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী। তাদের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনে চাল তৈরিতে খরচ বেশি পড়ছে তাদের। এ জন্য চালের দাম বাড়িয়েছেন মিলাররা। যা বস্তায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি হওয়ায় বাজার পর্যন্ত নিতে ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্রেতারা বলেছেন, প্রতিটি জাতের চালের দাম ছয় থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মোটা থেকে চিকন সব চালের দামই চড়া।

রাজশাহী নগরের বিভিন্ন বাজার ও দোকান ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে গত দুই সপ্তাহ ধরে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। পাইকারি ও চালকলের মালিকরা দাম বাড়ানোর কারণে খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে। গত শনিবার বাজারে বিআরআই-২৮ জাতের কেজি বিক্রি হয়েছে ৬৫-৬৮, যা গত সপ্তাহে ছিল ৬০-৬৫ টাকা। মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৭৮-৮০ টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহে ছিল ৬৮-৭৫ টাকা। নাজিরশাইল বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৬, যা ছিল ৭০-৭৮ টাকা। গুটি স্বর্ণার কেজি বিক্রি হয়েছে ৬০-৬৫, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫০-৫৫ টাকা।

রাজশাহী নগরের বাসিন্দা আলমাস হোসেন বলেন, ‘সব চালের দাম বেড়েছে। এভাবে বেড়ে যাওয়া আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য অনেক কষ্টের। সরকারের উচিত চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।’

নগরের সাহেববাজারের চাল ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মানভেদে ৫০ কেজি চালের প্রতি বস্তায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এখানে আমাদের কোনও হাত নেই। কারণ আমরা পাইকারি দরে কিনে সামান্য লাভ করে বিক্রি করে দিই।’

গত ২৯ ডিসেম্বর নগরের বিভিন্ন চালের আড়ত ও দোকানে দেখা গিয়েছিল, প্রতি ৫০ কেজি আঠাশ চালের বস্তা বিক্রি হয়েছে তিন হাজার টাকায়। মোটা চাল বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৪০০ টাকায়। জিরাশাইল বিক্রি হয়েছে তিন হাজার ২০০ টাকায়। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে এসব চালের বস্তায় দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এখন আঠাশ চাল বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৫০০ টাকায়। জিরাশাইল তিন হাজার ৮০০ টাকা।

চালকলের মালিকরা বলছেন, এখন মিলপর্যায়ে প্রতি বস্তা আঠাশ চাল বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ২৫০ থেকে তিন হাজার ৩৫০ টাকা। মোটা চালের বস্তা দুই হাজার ৭৫০ থেকে দুই হাজার ৮০০ টাকা ও জিরাশাইল তিন হাজার ৫০০ টাকায়। এই চাল আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে গেলে বস্তায় বেড়ে যাচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে ক্রেতার কাছে যেতে প্রকারভেদে বস্তায় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে যাচ্ছে।

গত শনিবার রাজশাহীর খুচরা বাজারে আঠাশ চাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৭২-৭৫ টাকা। গুটি স্বর্ণা বিক্রি হয়েছে ৬৩-৬৫ টাকা ও জিরাশাইল ৮০ টাকা।

এদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, কখনও সরবরাহ সংকট, কখনও ধানের দাম বেশি বলে চালের দাম বাড়ান চালকলের মালিকরা। আমনের ভরা মৌসুমে সংকটের কথা বলে আবারও বস্তায় সর্বোচ্চ ৩০০-৪০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে বেশি দামে কিনে পাইকারিতে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম তিন থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে। মাঝারি আকারের প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে সপ্তাহের ব্যবধানে ছয় থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত।

নগরের সাগরপাড়া এলাকার অমিত স্টোরের স্বত্বাধিকারী অমিত সরকার বলেন, ‘আড়ত থেকে চাল কিনতে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে আমাদের। গত এক সপ্তাহের মধ্যে দাম বেড়ে গেছে। প্রতি বস্তায় ৪০০-৫০০ টাকা বাড়তি গুনতে হয়। আবার বাড়তি দামে বিক্রি করা হলে গ্রাহকরা অসন্তুষ্ট হচ্ছেন।’

সাহেববাজারের এপি চাল ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী প্রকাশ প্রসাদ বলেন, ‘মিল থেকে চাল নিয়ে এসে বিক্রি করছি। গত কয়েকদিনে চালের দাম বেশ বেড়েছে। মিল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা উপকৃত হচ্ছেন। ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মিলে যদি কম দামে কেনা যায়, তাহলে আমরাও কম দামে বিক্রি করতে পারি।’

নগরের কাদিরগঞ্জ এলাকার পাইকারি চাল বিক্রেতা সততা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সোলায়মান আলী বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহ ধরে চালের দাম বাড়ছে। এজন্য আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। দাম কমলে আমরাও কম দামে বিক্রি করতে পারি। কিন্তু বেশি দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।’

কামাল অটোরাইস মিলের স্বত্বাধিকারী কামাল হোসেন বলেন, ‘এখন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ধান মজুত করে রেখেছেন। তারা বাড়তি দাম না পেলে ধান ছাড়ছেন না। ফলে তাদের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে। আমাদের খরচও আছে। এ কারণে বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে।’

রাজশাহী চালকল মালিক সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলামও ধানের দামকে দায়ী করছেন। তিনি বলেন, ‘চালের দাম বাড়লেই আমাদের দোষ হয়। কিন্তু এখন ধানের দাম বাড়তি থাকায় চাল করতে বেশি খরচ পড়ছে। এ কারণে মিল থেকে দাম বাড়ানো হয়েছে।

মজুতদারদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর রাজশাহীর উপপরিচালক ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিযান চলছে। চাল ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হচ্ছে। এরপরও যারা সতর্ক হচ্ছেন না, তাদের জরিমানা করা হচ্ছে।’

আরবি/জেডআর

Link copied!