ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে সাতক্ষীরার মৎস্য চাষিরা

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৩, ২০২৪, ০৬:৪৫ পিএম

অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে সাতক্ষীরার মৎস্য চাষিরা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ মৎস্য চাষের উপর নির্ভরশীল। আর এ কারণে জেলায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষাবাদ করে সাতক্ষীরাসহ দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে সাতক্ষীরার মৎস্য চাষিরা। এখানে হয়াইট গোল্ড নামে পরিচিত বাগদা ও গলদা মাছ এ মাছের সুনাম বর্তমানে দেশের  ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রশংসা কুঁড়িয়েছে।ইউরোপ সহ বহি:র্বিশ্বে রপ্তানিকৃত ৭০ ভাগ চিংড়ি সাতক্ষীরা থেকে উৎপাদিত হয়ে দেশের বাইরে যায় বলে জানা গেছে।

এদিকে জেলার কয়েকটা নদী নাব্যতা হারিয়ে ফেলাই সংশ্লিষ্ট এলাকায় চিংড়ি ঘেরে চিংড়ি মাছ চাষ করার জন্য লবণাক্ত পানির অভাব দেখা দেওয়ায় চিংড়ি মাছের সাথে সাথে আলাদা  আলাদা করে সাতক্ষীরা জেলায় মৎস্য চাষিরা বিভিন্ন জাতের সাদা মাছ, কাকড়াঁ ও কুচিয়া মাছ এর চাষ করছে পাল্লা দিয়ে। এসব মাছ এলাকার চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন মাছের আড়তে সরবরাহ হয়ে থাকে। দেশের ভিতরে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে নিয়মিত। বর্তমানে সাতক্ষীরার মৎস্য চাষিরা তাদের উৎপাদিত মাছের মান ও সুনাম বজায় রাখা সহ মাছের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য আধুনিকরণে সর্বদা তৎপরতা থেকে জেলার মৎস্য কর্মকর্তাদের সাথে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করে বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।এদিকে চিংড়ি মাছের চাহিদা দেশে ও দেশের বাইরে বেশি কদর থাকার কারণে বর্তমানে চিংড়ি চাষের জন্য প্রয়োজনীয় মাছের পোনা সাতক্ষীরা সুন্দরবন উপকূল এলাকার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ নওয়াবেকি হ্যাচারি থেকে উৎপাদিত হয়ে স্থানীয় বাজারে চিংড়ি মাছের রেনু পোনার সংকট নিবারণ করছে। যা সাতক্ষীরা জেলার মৎস্য চাষিদের জন্য চিংড়ি চাষের রেনু পনার সংকট দূরীকরণে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে।

জানা যায়, জেলায় ১ লাখ ৪০ হাজার ৭১ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৪৯ হাজার ২৮৬ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। যার মধ্যে ৬৭ হাজার ৬শত ৮৩ হেক্টর  জমিতে ৪০হাজার ৯শত ১১ মেট্রিক টন বাগদা ও গলদা ও অন্যান্য চিংড়ি মাছের উৎপাদন হয়। জেলার চাহিদার থেকে প্রায় দ্বিগুণ উৎপাদন মাছ বেশি হয়। 

মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলায় ৫৪ হাজার ৩শত ৫৮ মেট্রিক টন মাছের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ২শত ৮৬ মেট্রিক টন। যা জেলার চাহিদার  তুলনায় বেশি উৎপাদন হয়েছে ৯৪ হাজার ৯শত ২৭ মেট্রিক টন বেশি।

জানা যায়, জেলার ৫৪ হাজার ৯শত ৩৫টি জলাশয়ে ৫৮ হাজার ২শত ৯৪ হেক্টর জমিতে ২৬ হাজার ২শত ১৪. ৯৯ মেট্রিক টন বাগদা চিংড়ি মাছের চাষ হয় ও ১১ হাজার ৬শত ৬২টি জলাশয়ে ৯ হাজার ৩ শত ৮৯ হেক্টর জমিতে ১০ হাজার ২০৪ মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি চাষ হয়। এবং অন্যান্য নদী ও বিভিন্ন জলাশয়ে ৪ হাজার ৪শত ৯৩ মেট্রিক টন ছোট বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি মাছের  চাষ হয়। ৩৬৪টি কাঁকড়া ঘের এ ৩ শত ২১ হেক্টর জমিতে ১ হাজার ৯শত ৬৫ মেট্রিক টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়। ও সাতক্ষীরা জেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদের ৪৩ জায়গারও ১৩শ ২৬ সেক্টর জায়গায় ১হাজার হাজার ৫শত ২১ মেট্রিক টন বিভিন্ন মাছ উৎপাদন হয়, জেলার বিভিন্ন খাল ও বিলের ৪শত ৬টি জায়গার ৩ হাজার ২শত ৫ হেক্টর জমিতে ১৪ হাজারহ ১শত ৭৩ মেট্রিক টন বিভিন্ন মাছ  উৎপাদন হয়, জেলার বিভিন্ন বাওড়ের চারটি স্থানের হেক্টর জমিতে ২শত ৪ মেট্রিক টন মাস উৎপাদন হয় এবং জেলার সুন্দরবন পয়েন্টের একটি নদের ৫৫হাজার ৫শত২৪হেক্টর আয়তনে২হাজার ২শত ৫৯ মেট্রিক টন মাস উৎপাদন হয় এবং জেলার বিভিন্ন ধান ক্ষেতের ভিতরে ৩হাজার ৫ হেক্টর  জমিতে ২ হাজার ৪ মেট্রিক টন মাস উৎপাদন হয় এবং বারোপিট এলাকার ২শত ৫৮ হেক্টর জমিতে ১শত ৭৫ টন মাছ উৎপাদন হয়, রং বিভিন্ন স্তানের বিলের জমিতে ঘেরসহ অন্যান্য জলাশয় মিলে ৪০ হাজার ৬শত ৫৪ মেট্রিক  টন মাছ উৎপাদন হয়। মাছের সাথে সাথে জেলা থেকে ১শত ৯ মেট্রিক টন কুচিয়া উৎপাদন হয় যার দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরে রপ্তানি করা হয়। এবং সরকারিভাবে ১শত ৯৩টি পুকুরের ৪৮ হেক্টর জমিতে ২শত ৮৫ মেট্রিক টন বিভিন্ন জাতের মাছ উৎপাদন করা হয়, ও বিলের ভিতরে ছোট নার্সারি চারা মাছ ৩৯ মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন হয়। 

এদিকে বেসরকারিভাবে ৫৫ হাজার ৯শত ৬৯টি পুকুরে ৮ হাজার ৬শত ২১ হেক্টর জমিতে ৪৪ হাজার ৯শত ৮৬ মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন করা হয়।

মৎস্য চাষি সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার বড়বিলা গ্রামের রশিদ আমিন বলেন, আমি ৩০ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করি সেখানে মাছের  রেনু ও খাদ্য খরচ সহ চার লক্ষ টাকা খরচ হয়। মাছ ছাড়ার সাত মাস পরে বিক্রি করি তখন প্রায় ১০ লক্ষ টাকা কেনাবেচা হয়।

বাইগুনি গ্রামের নতুন উদ্যোক্তা মৎস্য চাষি বাদশা জানান, আমি নতুন হিসাবে চার বিঘা জমি হাড়ি নিয়ে এবার দুই লক্ষ টাকা খরচ করে মাছ চাষ করি কিন্তু এ বছর বর্ষার পানিতে ঘের  ডুবে যাওয়ায় আমার মাছ ভেসে যায় যার কারনে লাভ করতে পারি নাই তবে আসল টাকাটা ঘরে তুলতে পেরেছি।

তিনি আরো বলেন, সামনেবার নতুন করে আরো চার বিঘা জমি হাড়ি নিয়ে বড় আকার মাছের চাষ করার পরিকল্পনা আছে।

ঘের ব্যবসায়ী শাকদাহ গ্রামের সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি দীর্ঘদিন যাবত শাকদাহ বিলে ৫০ বিঘা জমি হারি নিয়ে মাছ চাষ করে আসছি তাতে  প্রতিবছর  আমার ভালো ব্যবসা হয় কিন্তু এ বছর বন্যার পানিতে ঘের ভেসে যাওয়ায় লাভের পরিমাণ কম হয়েছে।

মৎস্য চাষি ঝন্টু মোড়ল ও একিই কথা বলেন, তিনি ২০০ বিঘা জমিতে বাগদা, গলদা  ও সাদা মাছের  চাষ করেন। তিনি বলেন, এবার প্রাকৃতিক বন্যার কারণে ঘেরের অনেক মাছ ভেসে যাওয়ায় লাভের পরিমাণ বিগত বছরের চেয়ে কম হবে।

স্কটল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশের যশোর জেলার কোমরপুর গ্রামের চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, সাতক্ষীরা এলাকার মাছ অনেক সুস্বাদু আমরা বিদেশের মাটিতে  কোথাও বেড়াতে যেয়ে যদি শুনি সাতক্ষীরা থেকে কোন মাছ এখানে আসছে তখন কেনার চেষ্টা করি। তবে দেশের বাইরে থাকার কারণে সাতক্ষীরার টাটকা মাছের স্বাদ খুব মিস করি। তবে যখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসি তখন আর এই সুযোগকে মিস করি না সাতক্ষীরার বড়বাজার মাছের আড়ৎ, পাটকেলঘাটা বাজার ও  বিনেরপোতা মাছের আড়ৎ থেকে টাটকা মাছ ক্রয় করে নিয়ে আসি। 

মাছের দাম নিয়ে মৎস্য চাষি আজিজুল ইসলাম জানান, ১০০ গ্রাম ওজনের বাগদা চিংড়ি মাছের কেজি ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা, আর ১০০ গ্রামের নিচে হলে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি, আর গলদা মাছের কেজি ১০০ গ্রাম সাইজের ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা ১০০ গ্রামের ছোট হলে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি অপরদিকে সাদা রুই, কাতলা ও মৃগেল ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, তেলাপিয়া মাছ এক কেজি ওজনের মাছ ১৫০ টাকা কিজি দারে বিক্রি হচ্ছে। টেংরা বড় মাছের দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ভেটকি বড় মাছ ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে মাছ চাষিরা বিশাল খুশি।

মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলায় মৎস্য আমদানি কারক আছেন ৬জন এরা অনেক সময় দেশের বাইরে থেকে সাগরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এনে থাকেন।এদিকে  জেলার ভিতরে পাইকারি মাছের আড়ত আছে পাঁচটি এখানে প্রায় ৫০ জন পাইকারি বিক্রেতা আছে এরা সবাই এসব আড়ত থেকে মাছ নিয়ে খুলনা, ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং ঢাকার বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বাইরে রপ্তানি করে। এবং সাতক্ষীরা সদরে খুচরা মাছ বিক্রেতা আছেন ১২১ জন।

মৎস্য অফিস সূত্রে আরো জানা যায়, সাতক্ষীরাতে প্রক্রিয়াজাত করণ কারখানা আছে ৬টি, বাগদা চিংড়ি মাছের হ্যাচারি আছে ১২টি, গলদা চিংড়ি মাছের হ্যাচারী আছে ২টি, কাপ  হ্যাচারি ৪টি, মনোসেক্স ও সাদা অন্যান্য মাছের হ্যাচারি আছে ২৯ টি, ডিপো আছে ২৩৭ টি ও বরপকল কল আছে ৩৪টি।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরা জেলা দেশের ভিতরে মৎস্য চাষে মডেল হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। এ জেলা থেকে তিন ভাগের দুই ভাগ চিংড়ি মাছ বিদেশে রপ্তানি হয়। আমরা মৎস্য চাষীদের আধুনিকরনে সর্বদা সহযোগিতা করে থাকি।

মাছ চাষিদের বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত সম্পর্কে বলেন, এবার বন্যার পানিতে অনেক মৎস্য চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের মাছ ভেসে গেছে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক চাষি আর এ ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিরা কিভাবে উন্নতি লাভ করতে করে ক্ষতিপুষিয়ে উঠতে পারে আমরা সে ব্যাপারে চাষিদের  বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!