মোল্লা রেজাউল করিমকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক পদে পদায়নের পর থেকে দপ্তরটি অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ ও পোস্টিং বাণিজ্যের ডেরায় পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন অঞ্চলের অধীনে ১০টি বিভাগীয় অফিসের আওতায় প্রতিটি রেঞ্জ থেকে এক লাখ, প্রতিটি চেক স্টেশন থেকে এক লাখ, বনবিট থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে বন সংরক্ষক অফিসে দেওয়ার নিয়ম করা হয়েছে।
এ ছাড়া উন্নয়নমূলক কাজ থেকে ৫৩ শতাংশ, বাগান সৃজন ও রক্ষণাবেক্ষণ থেকে ৫ শতাংশ আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন মেরামত থেকে ৪৭ শতাংশ করে দিতে হচ্ছে ঘুষের টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপে এবং বনপ্রহরীদের পক্ষ থেকে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো অভিযোগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। পোস্টিংয়ের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বনভূমি বিক্রি, গাছ বিক্রির মতো ঘটনা ঘটছে।
এদিকে বন বিভাগে কী পরিমাণ জমি অবৈধ দখল হয়ে আছে তার সঠিক হিসাব নেই বন মন্ত্রণালয়ের কাছে। বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিম বর্তমান সময়ের জন্য এক মূর্তিমান আতংক হয়ে উঠেছে বন বিভাগে। অবশ্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিম এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বন বিভাগকে ঢেলে সাজাতে দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট ভাঙতে এ উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোল্লা রেজাউল করিম গত জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর চট্টগ্রাম বন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে চট্টগ্রাম সার্কেলের বন সংরক্ষক পদে যোগদানের পর থেকে কোনো আইন-কানুন, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছামতো বিধিবহির্ভূতভাবে বদলি নীতিমালা উপেক্ষা করে মোটা অংকের বিনিময়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ডিভিশনে বদলি ও নিয়োগ করেন। তার দাপটে সব বিভাগীয় বন কর্মকর্তাগণ, সহকারী বন সংরক্ষকগণ ও রেঞ্জ কর্মকর্তাগণ, বিভিন্ন বিট কর্মকর্তা, বন প্রহরী ও অফিস পিয়নরাও ভীত-সন্ত্রস্থ হয়ে পড়েছে।
বন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মোল্লা রেজাউল করিমের বন্ধু হিসেবে পরিচিত এসিএফ জয়নাল আবেদীন ও মো. আবদুল মালেক ফরেস্ট রেঞ্জারকে বিভিন্ন চেক স্টেশন ও রেঞ্জ থেকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা আদায় করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারা প্রতি মাসে বিভিন্ন চেক স্টেশন ও রেঞ্জ থেকে চাঁদা আদায় করে ১০ লাখ টাকা। প্রতিজন ফরেস্টার বদলি বাবদ নেন তিন লাখ টাকা। প্রতি বনপ্রহরী থেকে বদলি বাবদ ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা, বোটম্যান ও অফিস পিয়ন থেকে বদলি বাবদ ৫০ হাজার টাকা করে আদায় করে নীতিমালাবহির্ভূত বদলি ও পদায়নের আদেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান।
বন বিভাগের বিভাগীয় পর্যায়ে একাধিক সূত্র বলছে, সম্প্রতি যেসব বদলি ও পদায়নের ঘটনা ঘটেছে, তা থেকে এক কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য ও বদলি বাণিজ্য করেছেন।
সূত্র বলছে, এসব বদলি বাণিজ্যে সহযোগিতা করেন বনপ্রহরী আসলাম ও অমিরুল ইসলাম। তারা সবাই চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগে নিয়োজিত। চট্টগ্রামের বলিরহাট ও ফিরিঙ্গি বাজার অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ী এবং অবৈধ স’মিল ও অবৈধ ব্রিক ফিল্ড মালিকদের নিয়ে মিটিং করত; মাসোয়ারা নির্ধারণ করেছে।
তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বনপ্রহরী মো. আমির হোসেন গত ২২/১১/২০১৫ইং যোগদান করলেও তাকে বদলি না করে পরে ২৮/০৪/২০১৬ইং যোগদানকারীদের বিভিন্ন ডিভিশনে বদলি করেন। মো. আমির হোসেনের কাছ থেকে বদলি না করার শর্তে পরবর্তীতে ভালো কোনো ডিভিশনে বদলি করার আশ্বাসে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ থেকেও সিনিয়র বনকর্মীদের রেখে জুনিয়রদের বদলি করা হয়েছে।
এদিকে, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগে কর্মরত ছিলেন বনপ্রহরী মো. টিপু তালুকদার। তিনি একজন অসুস্থ ও পঙ্গু মানুষ। তার একটি পা কাটা। চাকরির বয়সও আছে মাত্র এক বছর। দুই লাখ টাকা দিতে না পারার কারণে তাকে উপকূলীয় বন বিভাগে বদলি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ থেকে খন্দকার আরিফুল হক ফরেস্টার ও মো. ইউনুছ বনপ্রহরীকেও নীতিমালার তোয়াক্কা না করে বদলি করেছে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বনপ্রহরী মো. ইউনুছ কর্মকালীন সময় মাত্র এক বছর। তাকে বদলি করা হলেও এই বন বিভাগে ৮-১০ বছর চাকরি আছে তারা বহাল তবিয়তে আছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বান্দরবান বন বিভাগে গত বছর বদলি তালিকায় ১নং সিরিয়ালে বনপ্রহরী নাসিরুল আলম, ২নং সিরিয়ালে মো. আবদুল কাদের খান। অথচ বদলি করা হয়েছে ৩ থেকে ৯নং সিরিয়াল পর্যন্ত। ফরেস্টার তৌহিদুর রহমান টগর সিরিয়ালে ১নং আছে, অথচ তাকে বহাল রেখে অন্যদেরকে বদলি করা হয়েছে।
বাগেরহাট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাগেরহাটে ইকোপার্ক নির্মাণকালে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে মোল্লা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়েছে। বদলি বাণিজ্যের ঘুষের টাকা, ঘুষ বাণিজ্যের সভা, কমিশন-এসব নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় নেতৃত্ব দেন বান্দরবানের বন বিভাগের ডিএফও আব্দুর রহমান, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের এসিএফ জয়নাল আবেদিন, ফরেস্টার ও ক্যাশিয়ার আবদুল হামিদ।
আর সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে বান্দরবান থেকে বদলি হওয়া ফরেস্টার জুয়েল চৌধুরী, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের ডিএফও আবদুল্লাহ আল মামুন, ফরেস্টার সাদেকুর রহমান, আনিচুর রহমানকে। এ সভায় ঘুষের টাকা আদায় করে মোল্লার আত্মীয়স্বজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এবং অন্যান্য জায়গায় হেফাজতে প্রেরণ করার বিষয়ে গোপন নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এদিকে ২০২০ সালের আগস্টে মহেশখালীতে অবৈধ পানের বরজ উচ্ছেদ করতে গিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ফরেস্টার মো. ইউছুফ উদ্দিন নিহত হন। এই হত্যার অন্যতম আসামি বনপ্রহরী মো. আহসানুল কবিরকে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে একজন হত্যা মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও উপকূলীয় বন বিভাগ চট্টগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগে বদলি করা হয়েছে সিন্ডিকেটের সদস্য মো. আমিরুল ইসলাম বন প্রহরীর মাধ্যমে। লামা বন বিভাগের মো. জামাল উদ্দিন বনপ্রহরী পিআরএল এ আছেন। টাকা না দেওয়ার কারণে তাকে লামা বন বিভাগ থেকে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে বদলি করা হয়।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, সুফল প্রকল্পের বনায়ন সৃজনে ৫ শতাংশ কমিশন ধার্য করে আদায় করা হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলে যেসব জোত পারমিট হয়ে থাকে সেসব জোত পারমিট থেকে প্রতি ঘনফুটে ১০ শতাংশ হারে টাকা নিয়ে আসছে। যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রতি মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা।
অপরদিকে, অফিস আদেশ নং-০১ তারিখ-৯/০১/২০২৫ইং মূলে ৮নং কলামে বর্ণিত ফরেস্টার মো. আনোয়ার হোসেন খানকে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের নলবিলা চেক স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে বদলি করা হয়। অথচ তিনি সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগে কর্মরত। ক্ষমতা জাহির করার জন্য ও বদলির ভীতি সঞ্চারের জন্য এসব গায়েবি অর্ডার করেন মোল্লা রেজাউল করিম।
এভাবে অর্ডার করে সবাইকে বদলির ভয় দেখিয়ে ইচ্ছামতো চাহিত টাকা আদায় করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বনপ্রহরী কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটি পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন বনকর্মী মো. আলমগীর।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, আগে যারা ছিল তারা পোস্টিং বাণিজ্য করে গেছে। আমি সেই শেকল ভাঙছি। নতুন দেশ গড়ার জন্য সরকার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, আমি সংস্কারকাজ করছি। পার্সেন্টেজ, বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেন তিনি।
ফুলছড়ি রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক শীতল পাল ফুলছড়ি ও ফাশিয়াখালী রেঞ্জের বনাঞ্চল ধ্বংস করেছে। বেশির ভাগ বনভূমি বেদখল হয়ে গেছে। সুফল বনায়ন নিয়েও হরিলুট করেছে বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিমের ক্যাশিয়ার এই শীতল পাল।
আপনার মতামত লিখুন :