সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় আতঙ্ক ও ক্ষোভের শহরে পরিণত হয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ। উপজেলার সাড়ে ৩ লাখ জনসংখ্যার জন্য রোহিঙ্গারা এখন বিষফোড়ায় রূপ নিয়েছে। অপহরণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে এই এলাকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে নাফ নদী, তার মাঝে পাহাড় নিয়েই সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ। অপরূপ সুন্দর্যের লীলাভূমি এই টেকনাফ একসময় ছিল বসবাসের নিরাপদ প্রশান্তির স্থান। নাফ নদীর উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে লবণের চাষ, সুপারির বাগান, সাগরে মৎস্য আহরণ, পানের বরজ ও ধান চাষ ছিল এই অঞ্চলের প্রধান জীবিকার মাধ্যম। এর সঙ্গে পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে এই উপজেলা কক্সবাজার জেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে ২০১৭ সালে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে টেকনাফে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে স্থানীয়রা পড়েছে নানা সংকটে। হত্যা, ডাকাতি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়সহ এমন কোনো অপরাধ নেই তারা করছে না, যা ২০১৭ সালের আগে কখনো এ এলাকায় ঘটেনি।
সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় আতঙ্ক ও ক্ষোভের শহরে পরিণত হয়েছে শহরটি। উপজেলার সাড়ে ৩ লাখ জনসংখ্যার জন্য রোহিঙ্গারা এখন বিষফোড়ায় রূপ নিয়েছে। অপহরণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে এই এলাকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রমতে, গত এক বছরে টেকনাফে অন্তত ১৮৭ জন অপহরণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ৯১ জন স্থানীয়, বাকিরা রোহিঙ্গা। এর মধ্যে অন্তত দেড় শ জনকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেতে হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর দুই দিনে টেকনাফে ২৭ জন অপহরণের শিকার হয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে টেকনাফের বাহারছড়ায় মুদি দোকানি জসিম উদ্দিনকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায় মুখোশধারীরা। ওই দিন সকালেই হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুড়া এলাকায় বনে কাজ করতে যাওয়া রোহিঙ্গাসহ ১৯ জন শ্রমিক অপহরণের শিকার হন। তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে অপহরণকারীরা জনপ্রতি ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তবে গতকাল এ অপহৃতদের মধ্যে ১৮ শ্রমিককে উদ্ধার করেছে র্যাব ও পুলিশ। গতকাল বিকেলে হ্নীলা ইউনিয়নের লেদার রংগীখালী পশ্চিমের দুর্গম পাহাড় থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়।
দীর্ঘ অভিযানে বনে অপহৃতদের উদ্ধার করা হয়েছে উল্লেখ করে কক্সবাজার র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের প্রচেষ্টা ছিল অপহৃতদের জীবিত উদ্ধার করার। মূলত ড্রোন অভিযানের ফলে অপহরণকারীরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে যায়। এর কারণে, আমরা অপহৃতদের উদ্ধারে সক্ষম হয়েছি। বাকি অপহৃতদেরও উদ্ধারে অভিযান চলছে।’
এদিকে গত মঙ্গলবার সকালে হোয়াইক্যং-শামলাপুর সড়কে দুটি অটোরিকশা থামিয়ে চালকসহ আরও আটজনকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে মুখোশধারীরা। খবর পেয়ে বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তবে অপহৃতদের নাম-ঠিকানা জানা যায়নি এবং এখনো পর্যন্ত তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, তবে তাদের উদ্ধারে কাজ করছে র্যাব ও পুলিশ।
বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক শোভন কুমার সাহা জানান, অটোরিকশা থেকে চালকসহ যাত্রী অপহরণের ঘটনা শুনে অভিযান চালানো হচ্ছে। কতজন অপহৃত হয়েছে তার সঠিক তথ্য এখনো জানা যায়নি। অটোরিকশা দুটি উদ্ধার করা হয়েছে।
স্থানীয় সচেতন সমাজ ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, বিশেষ করে উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়ায় অপহরণের ঘটনা বেশি ঘটছে। সবচেয়ে বেশি বাহারছড়ার নোয়াখালীপাড়া, বড় ডেইল, মাথাভাঙা, জাহাজপুড়া, ভাগগুনা, মারিশবনিয়া, হোয়াই্যকংয়ের ঢালা, চৌকিদারপাড়া, দক্ষিণ শীলখালী গ্রামের মানুষ বেশি অপহরণ ভয়ের মধ্য আছে। মূলত পাহাড়ি এলাকাগুলোয় বেশ কয়েকটি অপহরণ চক্র সক্রিয়। স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তির ছত্রছায়ায় তারা বিভিন্ন অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে।
গত সোমবার রাতে বাহারছড়া থেকে অপহৃত মুদি দোকানি জসিম উদ্দিনের ভাই জালাল উদ্দিন বলেন, ‘তিন বছর আগেও আমার আরেক স্বজনকে ধরে নিয়ে যায়। সে সময় হত্যার হুমকি দিয়ে ১৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল অপহরণকারীরা। ১৬ লাখ টাকা দিয়েই ওই আত্মীয়কে ফিরে আসতে হয়েছে।’
নাম গোপন রাখার শর্তে বাহারছড়ার এক জনপ্রতিনিধি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘মূলত প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে টেকনাফে এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে। গত দুই মাসে আমার এলাকায় ৩০ জনের বেশি অপহরণের শিকার হয়েছে। সবাই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছে।’
বাহারছড়ার এক ইউপি সদস্য বলেন, যতক্ষণ স্থানীয় মানুষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিরা যৌথভাবে কাজ না করবেন, তত দিন এই অপরাধ রোধ অসম্ভব।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঝিমিয়ে পড়ার বিষয়টি অস্বীকার করে অপহৃতদের উদ্ধারে অভিযান চলছে বলে জানান টেকনাফ মডেল থানার ওসি গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমরা গত জানুয়ারি থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩৮ জন অপহৃতকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। ২০টি মামলায় বেশ কয়েকজন অপরাধীকে আটক করা হয়েছে। সর্বশেষ গত সাপ্তাহে পাঁচ দালালসহ মালয়েশিয়ায় পাচারকালে ৬৬ জন ভিকটিম উদ্ধার করেছি।’
টেকনাফের ইউএনও শেখ এহেসান উদ্দীন বলেন, ‘পাহাড়ে স্থানীয়দের সহায়তায় অপহৃতদের উদ্ধারে র্যাব ড্রোন অভিযান চালাচ্ছে। আশা করছি, তাদের দ্রুত উদ্ধার করতে সক্ষম হব। পাশাপাশি অপহরণ ও মুক্তিপণ বন্ধে কর্তৃপক্ষকে যৌথ অভিযান চালানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’
উল্লেখ্য, এই অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় অপরাধে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কিছু স্থানীয় লোক সম্পৃক্ত রয়েছে। তারা শুধু অপহরণ নয়, বরং অবৈধভাবে মিয়ানমারে খাদ্যপণ্য পাচার করছে এবং ফিরতি ট্রিপে মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসছে বিশাল মাদকের চালান। সংশ্লিষ্ট এলাকার সূত্রে জানা যায়, ওই সব সিন্ডিকেটের রয়েছে ভারী অস্ত্র এবং প্রশিক্ষিত লোকবল। টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় তাদের রয়েছে সোর্স।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা সব তথ্য নিয়ে এগোচ্ছি। অপরাধী চক্রকে সমূলে বিনাশ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে দুর্গম পাহাড় হওয়ায় কাজ করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে স্থানীয় জনগণ এবং প্রতিনিধিদেরও আমাদের সাথে কাজ করতে হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :