ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

বৈধ পথে অবৈধ কারবার রাজস্ব হারাচ্ছে দেশ

বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৪, ২০২৪, ১২:৫৫ এএম

বৈধ পথে অবৈধ কারবার রাজস্ব হারাচ্ছে দেশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

যশোরের বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিন অবাধে আসছে ভারতীয় কম্বল। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব কম্বল বিক্রি করতে প্রতিদিন চেকপোস্ট এলাকায় বসছে ভারতীয় কম্বলের হাট। প্রতিটি কম্বল বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। যশোর, খুলনাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার শত শত মহিলা-পুরুষ বেনাপোল আসে এসব কম্বল কিনতে।

কম্বল ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন ভারত-বাংলাদেশের সহস্রাধিক পাসপোর্টযাত্রী ও ল্যাগেজ ব্যবসায়ীরা। উভয় দেশের প্রশাসনের সহযোগিতায় চলছে এ ব্যবসা। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি চক্র কম্বল ব্যবসার সাথে প্রতিদিন মাদক দ্রব্য, মোবাইল ও বিভিন্ন অবৈধ পণ্যসামগ্রী পাচার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিনা শুল্কে অবৈধ পণ্য দেশে প্রবেশ করায় মারাত্মক হুমকির মুখে দেশীয় শিল্প। স্থানীয় লাগেজ ব্যবসায়ীরা কাস্টমস কর্মকর্তা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনকে ম্যানেজ করে চালিয়ে যাচ্ছেন রমরমা এই অবৈধ ব্যবসা। এতে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। অবাধে ভারতীয় কম্বল পাচার হয়ে আসছে দেশে। কোনোমতে ঠেকানো যাচ্ছে না পাচার হয়ে আসা এই কম্বল। থামছে না পাচারকারী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য।

বিজিবি বলছে, সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে তারা দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

প্রতিদিন নিরাপদে-নির্বিঘ্নে হাজার হাজার পিস কম্বল ভারত থেকে পাচার হয়ে আসছে। যেন দেখার কেউ নেই। প্রতিদিন হাট বসছে বেনাপোল চেকপোস্ট হাসু চৌধুরী মার্কেটের সামনে, রাস্তায়, ফুটপাতে এবং বিভিন্ন দোকানের সামনে। পাচার হয়ে আসা ভারতীয় এসব কম্বল কেনার জন্য নারী-পুরুষ আসে ঢাকা, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, ঝিনাইদহসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। নারী ক্রেতারা এই ব্যবসার সাথে বেশি জড়িত। নিরাপদ বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বেনাপোল-খুলনা ‘বেতনা এক্সপ্রেস’ ও বেনাপোল-ঢাকাগামী ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস’ ট্রেন। স্থলবন্দর বেনাপোল থেকে খুলনার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া সকাল ও বিকালে দুটি ডাউন ট্রেনের বগি ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে এসব কম্বল। ট্রেনের সাধারণ যাত্রীরা এদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। ট্রেনের সিটের ওপর কম্বল রাখায় যাত্রীরা টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন যশোর-খুলনায়।ভারতীয় কম্বলের এ পাচার অনেকটা ওপেন সিক্রেট।

চেকপোস্ট সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে ভিসা প্রদান না করায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার যাত্রীর সংখ্যা অনেকাংশে কমলও ভারত থেকে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ ভারতীয় নাগরিক পাসপোর্টের মাধ্যমে বিজনেস ভিসায় বেনাপোল সীমান্তে প্রবেশ করছেন। এদের ভিসা দিচ্ছে কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন। যারা শতভাগ কম্বলসহ অন্যান্য চোরাচালান ব্যবসার সাথে জড়িত।

বেনাপোল সীমান্তের ওপারে ভারতের বনগাঁ, অশোকনগর, হাবড়া, হরিদাসপুর, জয়ন্তীপুর ও পেট্রাপোলে সক্রিয় রয়েছে একটি সঙ্ঘবদ্ধ পাচারকারী সিন্ডিকেট। ভারতীয় বিজনেস ভিসাধারী যাত্রীরা প্রতিদিন একেকজন ১০-১২টা করে এসব কম্বলসহ বিভিন্ন কসমেটিক সামগ্রী নিয়ে এসে বাংলাদেশের বেনাপোল চেকপোস্টে চোরাচালানি মহিলাদের কাছে ও বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন। এক ঘণ্টার মধ্যেই তারা আবার নিজ দেশে ফিরেও যাচ্ছেন। বিজনেস ভিসা থাকায় তাদের যাতায়াতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পাচার হয়ে আসা এসব কম্বলের মধ্যে কৌশল করে আনা হচ্ছে মাদকসহ নিষিদ্ধ পণ্যও। আবার ফেরার সময় নিয়ে যাচ্ছেন স্বর্ণসহ বিভিন্ন মূল্যবান মালামাল। এর সাথে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী যাত্রীও রয়েছেন। এ কাজে সক্রিয় সহযোগিতা দিচ্ছে ভারতীয় ও বাংলাদেশ কাস্টমসসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

ওপারের সিন্ডিকেট সদস্যরা ভারতফেরত বাংলাদেশি পাসপোর্টযাত্রীদের কাছে মাথাপিছু ৮-১০টি করে কম্বল ধরিয়ে দিচ্ছেন। বিনিময়ে এক-দুই হাজার টাকা দিয়ে দিচ্ছেন। আবার নিজেরাও ঠিক একই পরিমাণ কম্বল নিয়ে আসছেন।

এদিকে বাংলাদেশ কাস্টমসহ অন্যান্য সংস্থাকে ম্যানেজ করছে এখানকার সক্রিয় সিন্ডিকেট। কাস্টমস ও বন্দরের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল পার হওয়ার সাথে সাথে দূর-দূরান্ত থেকে আসা কম্বল ক্রেতা নারী ও পুরুষরা শুরু করেন দরদাম। দামে বোঝাপড়া চুকে গেলে কম্বলের লট রাখা হয় চেকপোস্টের বিভিন্ন দোকানের সামনে, রাস্তায় বা ফুটপাতে। নিত্যদিন ভারতীয় বিপুল পরিমাণ কম্বল পাচার হলেও দেখার যেন কেউ নেই। পাচার  হয়ে আসা ভারতীয় এসব কম্বলে ছেয়ে গেছে সীমান্তবর্তী হাট-বাজার। প্রতিদিন সকালে চেকপোস্ট এলাকায় ভারতীয় কম্বল আর ভারতীয় বিজনেস ভিসাধারী যাত্রীদের ভিড় দেখে মনে হয় ভারতের মিনি হাট।

জানা যায়, ল্যাগেজ পারাপারকারী যাত্রীদের কাছ থেকে প্রতিদিন অধিকাংশ অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মালের ক্যাটাগরির ভিত্তিতে টাকা আদায় করে থাকেন। যা পুল সিস্টেমে জমা হয়। সর্বনিম্ন এক হাজার থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচের রেট বেঁধে দেওয়া হয়েছে। চেকপোস্ট কাস্টমস অফিসের তল্লাশি কেন্দ্রে একজন নন-টেকার এবং একজন এআরও পদমর্যাদার কর্মকর্তা থাকলেও তাদের সাথে দফারফা করে লাগেজ ব্যবসায়ীরা শুল্ক ছাড়াই পণ্য পাচারের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার মালামাল পাচার হয়ে আসছে।

দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলের প্রবেশপথ দিয়ে যাতায়াতের সময় সাধারণ যাত্রীদের ব্যাগেজ স্ক্যানিং বা তল্লাশির নামে একশ গজ দূরত্বের মধ্যে দুটি স্ক্যানার মেশিনে চেক ও চার জায়গায় অহেতুক ব্যাগেজ তল্লাশির নামে সাধারণ যাত্রীদের হয়রানি করেন এসব কর্মকর্তা। তা না হলে তাদের পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। যে কারণে এ পথ দিয়ে প্রতিনিয়ত কমতে শুরু করেছে পাসপোর্টযাত্রীর চলাচল। যে কারণে সরকার হারাতে বসেছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।

আরো জানা যায়, আগে ভারত থেকে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ ট্রাক আমদানিপণ্য বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করত। এখন ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের অবাধ বিচরণে তা কমে ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাকে নেমে এসেছে।

আমদানিকারকরা বলছেন, বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমসে নামমাত্র তল্লাশি করে দীর্ঘদিন ধরে কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক উৎকোচ লেনদেনে রমরমা ল্যাগেজ বাণিজ্য চলছে। ভারত-বাংলাদেশের সহস্রাধিক চোরাকারবারি ল্যাগেজ ব্যবসা করছেন। অপরদিকে কাস্টমস কর্মকর্তারা সব যাত্রীকে চোরাকারবারি ভেবে তাদের ব্যাগে তল্লাশির নামে হয়রানি করছেন। যে কারণে এ পথ ছেড়ে অন্য পথে ভারতে যাতায়াত করছেন অনেক বৈধ পাসপোর্টযাত্রী।

বেনাপোল কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক ব্যবসায়ী নেতা জানান, আমদানিকারকরা সরকারি আমদানিনীতির প্রতিটি শর্ত পূরণ করে পণ্য আমদানি করেন। যা বেনাপোল বন্দরে পৌঁছাতে এক থেকে দুই মাস সময় লাগে। বন্দরে আসার পর তা কাস্টমসে পরীক্ষণ, শুল্কায়ন নির্ধারণ, রাজস্ব পরিশোধ, ছাড়করণ, লোড-আনলোড, পরিবহনসহ ইত্যাদি খরচ যোগ হয়, এরপর লভ্যাংশ।

তাতে অবৈধ লাগেজ ব্যবসায়ীদের পণ্য কম মূল্যে ঢাকাসহ বড় বড় বাজার দখল করে নেওয়ায় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। অনেকে লোকসান ঠেকাতে বাধ্য হচ্ছেন আমদানি বাণিজ্য বন্ধ করতে। এতে সরকার হারাচ্ছে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু দৃষ্টি কামনা করেছেন আমদানি-রপ্তানিকারকরা।

কাস্টমসের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ ব্যাপারে আমরা সজাগ আছি। পাসপোর্টযাত্রীরা কোনো হয়রানির শিকার হলে অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। লাগেজ পার্টি বন্ধে আমরা প্রতিনিয়ত চেকপোস্টে মালামাল ডিএমের মাধ্যমে আটক করছি। সেগুলো পরে যাত্রীরা কাস্টম হাউস থেকে শুল্ক দিয়ে ছাড় করিয়ে নিচ্ছেন।

এ বিষয়ে যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী জানান, সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে বিজিবি দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ডিসেম্বর ২০২৪ মাসে বেনাপোল এলাকায় ট্রেন ও বিভিন্ন মার্কেট এবং আবাসিক হোটেলে দুটি টাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনাসহ বেনাপোল এলাকা থেকে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ১৮ হাজার ২৭০ টাকা মূল্যের ভারতীয় এক হাজার ৭৩৪টি কম্বল, ১৫৭টি থ্রিপিস, ৩৬৪টি শাড়ি, ৮৮০ পিস তৈরি পোশাক এবং ৩৮ হাজার ৭৯টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কসমেটিকসহ অন্যান্য মালামাল আটক করা হয়েছে।

বিজিবি অধিনায়ক আরো জানান, চোরাকারবারি কর্তৃক মালামাল শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার করায় জব্দ করা হয়। এভাবে ভারতীয় দ্রব্যসামগ্রী চোরাচালানের কারণে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দেশ উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!